আজ ইউপিডিএফের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

আজ ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৯৮ সালের এই দিনে ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন (পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন) এর যৌথ উদ্যোগে এক পার্টি প্রস্তুতি সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় ইউপিডিএফ। গঠনলগ্ন থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি আজ ২৩ বছর পূর্ণ করলো।

শুরু থেকেই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয় ইউপিডিএফকে। একের পর এক ষড়যন্ত্র ও নিষ্ঠুর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন মোকাবেলা করে অভিষ্ট লক্ষ্য পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায়ে অবিচলভাবে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ইউপিডিএফ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন, অন্যায় দমন-পীড়নসহ সকল ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইউপিডিএফ সব সময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অব্যাহত দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, তিন শতাধিক নেতা-কর্মী-সমর্থক খুন-গুমের শিকার হওয়ার পরও ইউপিডিএফ দমে যায়নি।

ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পাশাপাশি দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনগণসহ সমতলের সকল জাতিসত্তাসমূহের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াইয়েও সমানভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের সকল নিপীড়িত জনগণের সাথেও ইউপিডিএফ একাত্মতা প্রদর্শন করে আসছে।

একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ইউপিডিএফ দেশের অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এতে দলটি বিপুল জনসমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

বিগত ২০০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেস আয়োজনের মাধ্যমে ইউপিডিএফ ৬ দফা মৌলিক দাবিনামা, ১৬ দফা সম্পুরক দাবিনামা ও ২০ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারই ভিত্তিতে ইউপিডিএফ তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

ইউপিডিএফ’র মৌলিক দাবিনামাগুলো হচ্ছে– ১. পররাষ্ট্র, মূদ্রা, প্রতিরক্ষা ও ভারী শিল্প ব্যতীত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সকল বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি আঞ্চলিক সংস্থার নিকট হস্তান্তরিত করার মাধ্যমে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েম করা; ২. পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরুং, খুমি, চাক, খিয়াং, লুসাই, পাংখো, বম, তনচংগ্যা, সাঁওতাল, গুর্খা, অহোমী ও রাখাইন জাতিসত্তাগুলোকে সংবিধানে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং বাংলাদেশে বসবাসরত সকল জাতি ও জাতিসত্তা সমানাধিকার ও সমমর্যাদা ভোগ করবে এই নিশ্চয়তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা; ৩. বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর জন্য সংরক্ষিত আসনের (মহিলা আসনসহ) বিধান করা ও উক্ত আসনসমূহে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা;  ৪. অপারেশন উত্তরণের নামে বলবৎ সেনাশাসন বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা; ৫. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত সেটলারদেরকে জাতিগত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা এবং তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের স্ব স্ব জেলায় অথবা অন্য কোন সমতল জেলায় জীবিকার নিশ্চয়তাসহ সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। নতুন সেটলার অনুপ্রবেশ ও পুনর্বাসন বন্ধ করা ও ৬. প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনার পূর্ণ অধিকার প্রদান করা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়িত জনগণের বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায়ের লড়াই চালিয়ে যেতে ইউপিডিএফ বদ্ধ পরিকর। যতই নিপীড়ন-নির্যাতন নেমে আসুক না কেন ইউপিডিএফের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কিছুতেই স্তব্ধ করা যাবে না– এমনই প্রত্যয় দলটির নেতা-কর্মীদের।

২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইউপিডিএফের সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা গতকাল (২৫ ডিসেম্বর) সংবাদ মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে সরকারের প্রতি দমনপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সাথে বিবৃতিতে তিনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর প্রতি যৌথ আন্দোলনের প্রস্তাবও দিয়েছেন।

এতে তিনি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘অতীতে যেমন ব্যাপক দমনপীড়ন চালিয়ে কিংবা মুখোশ বাহিনী ও বোরকা পার্টিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লেলিয়ে দিয়েও জনগণের আন্দোলনকে ধ্বংস করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না।’

উক্ত বিবৃতিতে প্রসিত বিকাশ খীসা জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ন্যুনতম কর্মসূচীর ভিক্তিতে দুই পার্টির নেতৃত্বে যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনসংহতি সমিতির প্রতি প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, ‘শুধু মুখের কথায় সরকারের চিড়ে ভিজবে না এবং সরকারের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র চুক্তি বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ করে আরাম আয়েশে বসে থাকলে হবে না। মনে রাখা দরকার, ১৯৯৭ সালের চুক্তি যেমন তৎকালীন পিসিপি-পিজিপি ও জেএসএস-এর যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলনের ফসল, তেমনি জনগণের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে কখনই এই চুক্তি বাস্তবায়ন কিংবা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না’।

এদিকে, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানো, দেওয়াল লিখন, চিকা মারা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে বলে ইউপিডিএফ জানিয়েছে।

অন্যদিকে, ইউপিডিএফ’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যানার-ফেস্টুন খুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে সেনা টহল জোরদার করার খবর পাওয়া গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *