সুনীল চাকমা, রাঙ্গামাটি।
আগস্ট ৯ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এ উপলক্ষে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছি, চাকমা জনগোষ্ঠীর রাজা, চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে। এই সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন শতরূপা বড়ুয়া। এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিগুলো রাজা দেবাশীষ রায়ের সৌজন্যে পাওয়া।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ রাজা হিসেবে দেবাশীষ কী ধরণের ক্ষমতা ভোগ করেন? যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ বা বিভিন্ন জেলা পরিষদগুলোর কার্যক্রমে কোন ভূমিকা থাকে কি? থাকলে কি ধরণের ভূমিকা থাকে?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ ”ক্ষমতা ভোগ’’ করার চেয়ে দায়িত্ব পালন করা বললে বেশী যথাযথ হবে।
চট্টগ্রামের তিন ঐতিহ্যবাহী সার্কেলে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব ও ভূমিকা হচ্ছে বিচারিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে, পাহাড়ি জাতিসমূহের পারিবারিক ও অন্যান্য প্রথাগত আইনের বিষয়ে আপীল আদালতের ভূমিকায় ।
তিন রাজা পদাধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড-এর পরামর্শক কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। আমরা সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের সভায় যোগদান করতে পারি, তবে ভোটে অংশগ্রহণ না করে। আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্ব স্ব সার্কেলের মৌজা হেডম্যান ও গ্রামের কার্বারী (গ্রাম প্রধান)-দের বিচারিক, রাজস্ব, সাংস্কৃতিক ও প্রথাগত সামষ্টিক ভূমি ব্যবস্থাপনার ভূমিকার তদারকি করা। ২,৪২১ বর্গমাইল জুড়ে চাকমা সার্কেল নামক আমার এখতিয়ারাধীন এলাকাতে ১৭৯ জন হেডম্যান ও ১,৮৫৬ জন কার্বারী রয়েছে (যাদের মধ্যে ৩৩৬ জন নারী)।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ পার্বত্য শান্তি চুক্তির (১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত) কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? কোন কোন প্রধান দিক এখনও বাস্তবায়ন করা যায় নি? কেন?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ সরকার ও জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হওয়া ও চুক্তিতে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতিষ্ঠা ও পুনঃগঠন ছাড়া চুক্তির মূল বিষয়গুলো হয় একেবারেই বাস্তবায়ন হয়নি অথবা কেবল আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।
যে বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি তার মধ্যে রয়েছে,
(ক) নির্ধারিত এলাকা ও সংখ্যার বাইরে সামরিক ক্যাম্পসমূহের পার্বত্যাঞ্চলের বাইরে সরিয়ে না নেওয়া;
(খ) অভ্যন্তরীন পাহাড়ি উদ্ভাস্তুদের স্ব স্ব ভিটেমাটিতে একবারেই পুনর্বাসন না হওয়া;
(গ) ভারত প্রত্যাগত জুম্মো শরনার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে তাদের স্ব স্ব ভিটেমাটিতে পুনর্বাসন না করা;
(ঘ) আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ সমূহকে যথাযত ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর না করা;
এবং (ঙ) চুক্তির আলোকে প্রতিষ্ঠিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কর্তৃক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া।
চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে, এবং এ বিষয়ে আমার একাধিক প্রকাশনাও রয়েছে। আমি তিনটি প্রধান কারণ উল্লেখ করব,
(১) চুক্তির বিধানাবলী জাতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত না হওয়া;
(২) এলাকার পূর্বেকার স্বশাসিত প্রশাসনিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা;
(৩) পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি জাতি-সত্বাসমূহের পরিচয় ও স্বকীয়তার প্রতি সহানুভূতির অভাব;
(৪) রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং সিভিল ও সামরিক কর্মকর্তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের জাত্যাভিমানী ও অসহিঞ্চু মনোভাব;
(৫) শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ চাকমা জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বর্তমান অবস্থা কি?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ দেশের আদিবাসী জাতির ভাষা সহ পাবর্ত্য চট্টগ্রামের তিনটি পাহাড়ি জাতির ভাষায় সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচের ক্লাসের জন্য বই ছাপানো হয়েছে। তবে দু-তিন বছর হওয়ার পরও শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের কোন বালাই নেই।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হলো। বাংলাদেশের সংবিধান চাকমা ভাষা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি সত্তার ভাষায় অনুবাদ হয়েছে কি? এ ব্যাপারে আপনি নিজে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ বাংলা ছাড়া দেশে কোন ভাষায় সংবিধান আছে বলে মনে হয়না। না, আমি কোন উদ্যোগ নেইনি। তবে আামাদের আদিবাসী জাতিদের পরিচয় ও স্বকীয়তা যদি প্রত্যক্ষভাবে এবং যথাযথভাবে স্বীকৃত হতো, তখন অনেকেই উৎসাহভরে নিশ্চয়ই উদ্যোগ নিত।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে গিয়ে, ১৯৬০ দশকের শুরুতে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে সৃষ্ট হওয়া কাপ্তাই লেকে ৫৪,০০০ একর আবাদি জমি সহ চাকমা রাজপ্রাসাদ পানির নিচে তলিয়ে যায়। এরপর ১৯৮৬ তে একবার ও ২০০৬ তে আরেকবার লেকের পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ডুবে যাওয়া প্যালেস টি ভেসে ওঠে। আপনি সেই ২০০৬-এ এই প্রাসাদটি সংরক্ষণ ও রক্ষণবেক্ষনের জন্য দাবী জানিয়েছিলেন? প্রাসাদটির বর্তমান অবস্থা কি ?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ নিচের রাঙামাটির প্রাসাদের কিছু ইট ও কংক্রীট কেউ কেউ নিয়ে গেছে। জলে নিমজ্জিত থাকার কারণে এর সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
তবে এর চেয়ে ২০০-২৫০ বছর পুরানো রাজানগরের প্রাসাদের সংরক্ষণের বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রীর সাথে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।
এই প্রাসাদ, বৌদ্ধ মন্দির, বাংলাদেশের প্রথম ভিক্ষুসীমা (’’ঘ্যাং’’) সমতল চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাতে আমাদের পরিবারের ব্যবস্থাপনায় এখনও রয়েছে। আমাদের ব্যবস্থাপনায় যদি সরকার পুনঃগঠনের ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করেন, তা আমরা গ্রহণ করবো বলে আমি মন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়েছি।
নিচের রাঙামাটি প্রাসাদ কেবল ভাঙ্গা দেওয়াল ও ইটের অংশবিশেষ রয়েছে। পক্ষান্তরে রাজানগরের প্রাসাদ এখনও দাড়িয়ে রয়েছে, তবে অনেক ঝুঁকিতে।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ চাকমা অধুষ্যিত এলাকায় গত কয়েক বছরে পর্যটন অনেক বেড়েছে। এর কি ধরণের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আপনাদের ইকোসিস্টেম এ পড়েছে, বা পড়ছে?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ পর্যটন সম্প্রসারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরের পুজির ভিত্তিতে ও তত্ত্বাবধানে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর প্রভাব পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। তবে গ্রামের জন-মানুষের সমষ্টিগত মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায়, স্থানীয় কৃষ্টি ও পরিবেশ বান্ধবভাবে হলে তা কাংক্ষিত। কিন্তু বর্তমানের মূলধারার পর্যটনের ধারা আমাদের কাংক্ষিত নয়।
ভয়েস অফ আমেরিকাঃ বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী দিবসে আপনার জনগোষ্ঠীর জন্য আপনি যদি তিনটি বিষয়ে সরকার অগ্রাধিকার দিক বলে চান, তবে সে তিনটি অগ্রাধিকার কি হওয়া উচিত ?
রাজা দেবাশীষ রায়ঃ
(১) সাংবিধানকে সংস্কার করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার সংরক্ষণ এবং পাবর্ত্যাঞ্চলসহ দেশের সকল আদিবাসী জাতিসমূহের পরিচয়, স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যের স্বীকৃতি;
(২) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর দ্রুত, পূর্ণাঙ্গ ও অন্যান্যভাবে যথাযথ বাস্তবায়ন;
(৩) বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ, দলিত, চা বাগানের কর্মীসহ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রেক্ষিত- ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ।