গত ১৪ অক্টোবর ২০১৯ আনুমানিক বিকাল ৩:০০ টায় বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ফাত্রাঝিরি এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর গুলিতে দুই আদিবাসী তঞ্চঙ্গ্যা নিহত হয়েছেন। নিহত দুই ব্যক্তির পরিচয় মংখিচা তঞ্চঙ্গ্যা (৬০) ও অংচাই মং তঞ্চঙ্গ্যা (৪৫)। হত্যাকান্ডটি নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, ঘুমধুম ইউনিয়ন নির্বাচনে ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য পদের জন্য একমাত্র আদিবাসী প্রার্থী বাবুল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা’র বিজয় প্রতিরোধের লক্ষে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়াই বিজিবি সদস্যদের কর্তৃক অতিরিক্ত ক্ষমতা ব্যবহারের কারণে এই হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়।
উল্লেখ্য যে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাধীন তিনটি ইউনিয়ন, যেমন- নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, সোনাইছড়ি ও ঘুমধুম ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৪ অক্টোবর ২০১৯। আহমদ আলী নামে বাঙালি সম্প্রদায় হতে একজন এবং বাবুল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা নামে আদিবাসী তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় হতে আরেকজন মোট দুই জন প্রার্থী ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, ঘুমধুম ইউনিয়নের অধীন ৮নং ওয়ার্ডের নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য প্রার্থীর সমর্থকরা সকাল ১০:০০ টার একটু পরই স্থানীয় বাঙালি ও রোহিঙ্গা লোকজন কর্তৃক জাল ভোট প্রদানের অভিযোগের বিষয়ে ফাত্রিঝিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সম্মুখে এক উত্তপ্ত বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। ঐ সময় বাবুল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার সমর্থকরা আহমদ আলীর পক্ষে জাল ভোট প্রদানের চেষ্টাকালে কয়েকজন রোহিঙ্গাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। জাল ভোট প্রদানকারী এই রোহিঙ্গাদের পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এরপর, বিকাল ৩:০০ টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদান অব্যাহত থাকে।
স্থানীয় সূত্রের অভিযোগ, সংঘর্ষের জের শুরু হয় বিকাল আনুমানিক ৩:০০ টায় প্রার্থী আহমদ আলীর সমর্থক বাঙালিরা যখন ফাত্রিঝিরি পাড়ায় বাবুল কান্তি’র বাসা’র সম্মুখে শান্তিপূর্ণভাবে বসে থাকা বাবুল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার সমর্থকদের উপর আচমকা হামলা চালায়। হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে, সেখানে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত বিজিবি সদস্যরা যখন মুখোমুখি দুই দলকে ছত্রভঙ্গ করা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার নামে গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে মংখিচা ঘটনাস্থলেই নিহত হন, অপরদিকে অংচাই মং গুলিতে মারাত্মকভাবে জখম হন। অংচাই মংকে দ্রুত কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে, সেখানে বিকাল ৪:৩০ টার দিকে ডাক্তারগণ তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
অভিযোগ রয়েছে যে, আক্রমণকারী বাঙালি লোকদের ছত্রভঙ্গ করতে বিজিবি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং বিজিবি সদস্যরা যে তঞ্চঙ্গ্যা লোকজন কেবল বাঙালিদের হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করছিল তাদের উপরই গুলি বর্ষণ করে। ঐ সময় ঘটনাস্থলে কোন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন না এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়াই বিজিবি গুলি বর্ষণ করে। স্থানীয় আদিবাসী জনগণের অভিযোগ, সেখানে এমন কোন ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল না যাতে বিজিবি সদস্যরা গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়। এটা বিজিবি সদস্যদের কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া কিছু নয় এবং এটা মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগণকে সহজ ও দূর্বল লক্ষ্যবস্তু হিসেবে সংঘটিত করা হয়।
কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপরোল্লিখিত দুই তঞ্চঙ্গ্যা ব্যক্তিসহ ৭টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপভাবে, অভিযোগ রয়েছে, সাদা পোশাকধারী আইন-প্রয়োগকারী ও নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক নিখোঁজের শিকার হয়েছেন ৪ আদিবাসী, যাদের মধ্যে ২ জনকে অজ্ঞাত স্থানে কয়েকদিন আটক রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ২ জন নিখোঁজ অবস্থায় আছেন। এই সময় অন্তত ৭৬ জন আদিবাসী ব্যক্তিকে একতরফাভাবে গ্রেফতার করা হয়, অপরদিকে ৭ জনকে কিছু সময়ের জন্য আটক রাখা হয় এবং নৃশংসভাবে নির্যাতন করা হয়। উচ্চ আদালত কর্তৃক মঞ্জুরকৃত জামিন অনুসারে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় বা বের হওয়ার পূর্বে ৫ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ অন্তত ১০ ব্যক্তিকে একের পর এক গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়া, প্রায় ২৭৮ জন আদিবাসীকে ১৭টি সাজানো মামলায় মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করা হয়, অপরদিকে অন্তত ২২টি বাড়িতে তল্লাশী চালানো হয়। তল্লাশীর সময় বহু গ্রামবাসীকে হয়রানি করা হয়। এছাড়াও, আদিবাসী নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত ১০টি ঘটনার অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ২ নারীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় যে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র ধারা লংঘন করে ২০১৯ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় তিনটি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।