প্রিতম বড়ুয়া অসি
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর ফ্যাসিস্ট দমনপীড়নের মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। তারা জনগণের আন্দোলনকারী দল ও সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তাদেরই সৃষ্ট ও মদদপুষ্ট জুম্ম রাজাকার লেলিয়ে দিয়ে পরিস্থিতিকে প্রতিনিয়ত অশান্ত ও অস্থির করে তুলছে। সামান্যতম গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগও তারা সহ্য করছে না। অত্যাচারের মুখে ইউপিডিএফ বহু আগেই বিভিন্ন স্থানে তাদের পার্টি অফিস বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল; যেখানে বন্ধ করা হয়নি সেখানে ফ্যাসিস্ট বাহিনী নিজেরাই তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। এতদিন কেবল তাদের বান্দরবান জেলা ইউনিট অফিসটি নামেমাত্র খোলা রাখা হয়েছিল। দেশে করোনা পরিস্থিতি ও ভয়াবহ সরকারি দমননীতির কারণে সেখানে তেমন কোন কার্যক্রমও ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত ১৩ অক্টোবর ফ্যাসিস্ট বাহিনী তাদের মদদপুষ্ট জুম্ম রাজাকারদের দিয়ে ইউপিডিএফের বান্দরবানের নিভু নিভু সেই অফিসটিও বন্ধ করে দিয়েছে। এর কিছুদিন আগে তারা ইউপিডিএফের বান্দরবান জেলা সংগঠক ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার বাড়ি ঘেরাও করে: উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করা। যে ব্যক্তি এসব ঘটনায় নেতৃত্ব দেয় তার নাম হলো কালাচোখ চাকমা ওরফে অতল, ২০১০ সালে একবার সে ছোটনকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। আদালতে এ অপরাধ প্রমাণিত হলে সে ২ বছরের সাজা প্রাপ্ত হয়। কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত হলেও সে বান্দরবানে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজির উৎসব করছে এবং বিভিন্নজনকে হুমকি-ধমকিসহ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। দেশের আইন আদালত তার কাছে বড়ই অসহায়!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে যে এসব করছে, তার পেছনে খুঁটির জোর কোথায়? সে ঝাড়-জঙ্গলে এসব করছে না, খোদ বান্দরবান শহরে, যেখানে পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনীর একটি বিগেড ও নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে, সেখানেই এসব বেআইনী সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে বেড়াচ্ছে। আর অতল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী এতই দক্ষ, এতই পারঙ্গম যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে দেখতে পায় না, তাকে ধরতে পারে না, তার নাগাল পায় না! ঘটনা ঘটিয়ে সে বাতাসের বেগে উধাও হয়ে যায়। তার কাছে সবাই ধরাশায়ী!
অতল বাবু কীভাবে বা কোন যাদু বলে নিরাপত্তা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব করতে পারে সেটা অন্যরা না জানলেও পাহাড়ি-বাঙালি সাধারণ জনগণ ঠিকই জানে, আমরাও জানি। কিন্তু জানলেও সেটা মুখ খুলে বলা এখন বড়ই বিপজ্জনক একটা ব্যাপার। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে সত্য কথন নিষিদ্ধ, সর্বত্র মিথ্যারই জয়জয়কার।
ইউপিডিএফের উপর দমনপীড়ন নতুন নয়, অবাক হবার বিষয়ও নয়। যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং নিজ জাতি ও জনগণের পক্ষে যারাই লড়াই করেছে তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে। আওয়ামী লীগের কথাই ধরা যাক। এ দলটি বিপ্লবী কোন দল নয়। বাংলাদেশে বামপন্থী বিপ্লবীদের ব্যর্থতাই এ দলটির উত্থান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব তার হাতে চলে যাওয়ার জন্য দায়ি। যাই হোক, ১৯৬০ দশকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ফলে দলটির উপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়ন বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে ৮ মে ১৯৬৬ ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে’ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর কয়েক দিনের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রায় সব প্রধান নেতাকে পুলিশ আটক করে কারাগারে নিয়ে যায়। (আওয়ামী লীগ উত্থান পর্ব ১৯৪৮ – ১৯৭০, মহিউদ্দিন আহমদ, পৃ: ১৪০)। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ৭ জুন হরতাল পালন করে এবং এ সময় পুলিশের গুলিতে ও পুলিশ-জনতার সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘৭ জুনের হরতালের পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই থিতিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা জেলে বন্দী। আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রায় একাই দলকে নেতৃত্ব দেন। তিনিই ছিলেন নেতাবিহীন আওয়ামী লীগের ওই সময়ের কাণ্ডারি।’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর দলটির অবস্থা হয় আরও করুণ। ‘অধিকাংশ নেতা জেলে আটক থাকার কারণে আওয়ামী লীগের তখন ছন্নছাড়া অবস্থা। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে সক্রিয় জনমত গড়ে তোলার মতো অবস্থা তখন দলটির ছিল না।’ এমনকি মামলার আসামীদের পক্ষে উকিল নিয়োগের ব্যবস্থা করাও ছিল আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন ব্যাপার। এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সহ চার তরুণ আইনজীবী যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায় গিয়ে বেগম মুজিবের সাথে দেখা করেন, তখন বেগম মুজিব তাদের বলেছিলেন, ‘আমার বাড়ির ওপর দিয়ে এখন কাক পর্যন্ত ওড়ে না। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবেরা এই রাস্তা দিয়ে আর যায় না, আমাদের বাড়ি এড়াবার জন্য অন্য রাস্তা দিয়ে যায়। বন্ধুবান্ধবেরা যারা তার (মুজিবের) কাছ থেকে উপকার পেয়েছে তারাও আর আসে না, আপনাদের তো আমি চিনি না।’ (প্রাগুক্ত, পৃ: ১৭৪) আওয়ামী লীগের এই চরম দুঃসময়ে অনেক নেতা দল ছেড়েছিলেন অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এভাবে শত দমনপীড়ন চালিয়েও আওয়ামী লীগের মতো শৃঙ্খলায় ঢিলেঢালা একটি দলকে ধ্বংস করতে ও আন্দোলন দমন করতে পারেনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ সেই আওয়ামী লীগ ও বাঙালি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে অস্বীকার করছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের মতো একই কায়দায় জুম্ম জনগণ ও তাদের দল ইউপিডিএফের উপর দমনপীড়নের স্টীম রোলার চালাচ্ছে। যে আওয়ামী লীগ একদিন বাঙালি জাতির উপর পরিচালিত পাকিস্তানী শাসকদের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই একই আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নিজেই নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ওপর বর্বর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু গত ২৩ বছর ধরে চরম দমনপীড়ন চালিয়েও ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস করা যায়নি। পার্টির শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়েছে, অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ রাখা হয়েছে, মিথ্যা মামলা-হুলিয়ায় জর্জরিত করা হয়েছে, কিন্তু তাদের অদম্য সংগ্রামী মনোবলকে হার মানানো যায়নি। ইউপিডিএফ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি, বরং শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শুন্য থেকে যাত্রা করে একটি শক্তিশালী পার্টিতে পরিণত হয়েছে।
শেষে একটি সত্য উচ্চারণ করা দরকার। পশ্চিম পাকিস্তানীরাও বাঙালিদের মধ্য থেকে রাজাকার সৃষ্টি করে বাঙালিদের সংগ্রামী চেতনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। আজ বাঙালি শাসকগোষ্ঠীও (বাঙালি জনগণ নয়) পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের মধ্য থেকে জুম্ম রাজাকার সৃষ্টি করে জুম্মদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমন করতে চাইছে। কিন্তু তারাও এতে কোনদিন সফল হবে না। চুক্তির আগেও রাজাকারের মতো বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু গণআন্দোলনের জোয়ারে সেগুলো খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল। আজ যে জুম্ম রাজাকাদের দাপট, তাও একদিন শেষ হতে বাধ্য। পৃথিবীতে যে জাতি বা জনগণ নিজেদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে, সে জাতি বা জনগণকে চিরকাল দাবিয়ে রাখা যায়নি, তারা একদিন মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। জুম্ম জনগণের সুমহান সংগ্রাম ও অত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না।