সংগ্রাম মুখর দিনগুলো চির অম্লান
-প্রসিত বিকাশ খীসা
ঊননব্বই হতে দু’হাজার এক সাল – পুরো এক যুগ সময়। আমাদের প্রিয় সংগঠন ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’ [পিসিপি] অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ঝড় ঝঞ্ছা মোকাবিলা করে পূর্ণ করেছে বার বছর। এই সুদীর্ঘ বার বছরে পিসিপি’র গর্ব করার মতো আছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল দিন। আমাদের জীবনের স্মরণীয় দিনগুলোর মাঝে পিসিপি’র উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলো রয়েছে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে। স্বাভাবিকভাবে পিসিপি’র এক যুগপূর্তি আমাদেরকে করে স্মৃতিকাতর, করে উদ্বেলিত এবং আন্দোলিত। এ সংগঠনের সাথে জুড়ে আছে আমাদের অনেক দিনের অনেক স্মৃতি। মিটিং-মিছিলের প্রাণচাঞ্চল্য, আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাপ, তারুণ্যের উত্তেজনা আর অনেক সফল অনুষ্ঠানের আনন্দঘন মুহুর্ত-সেই দিনগুলো এখনো সজীব, এখনো জীবন্ত। যদি পেছনের দিনগুলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো, মনে হয় আরো নির্ভুলভাবে করা যেতো আরো কাজ! সংগঠনকে করা যেতো আরো সুন্দর আরো সুশৃঙ্খল! পেছনে ফেলে এসেছি দীর্ঘ এক যুগ, তবুও মনে হয় এই কেবল সেদিন! পিসিপি’র নতুন বন্ধুদের দৃপ্ত মিছিল দেখলে আজো উদ্দীপ্ত হই। এ সংগঠনের সাথে আছে যেমন গৌরব আর বীরত্বপূর্ণ ঘটনা, আছে তেমনি দুঃখও। প্রিয় সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা।
এক সময় পিসিপি’র প্রতিবাদী মিটিং-মিছিল-সমাবেশে উদ্যত রাইফেল-মেশিনগান-বেয়নেট আর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সমবেত হয়েছিলো হাজারো অকুতোভয় নির্ভীক প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা। ষড়যন্ত্রমূলক মামলা-হুলিয়া-জেল-জুলুম-নিপীড়ন নির্যাতন কিংবা গুপ্ত হত্যার হুমকি কোন কিছুই সে সময় মুক্তিকামী প্রতিবাদী তরুণদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠির সব বাধা উপেক্ষা করে শত শত ছাত্র সমবেত হয়েছিলো পিসিপি’র পতাকাতলে। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নস্যাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আন্দোলন সংগ্রামে। কোন প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি তাদের নিরস্ত করতে পারেনি। ছাত্র-জনতার সমাবেশে দাঁড়িয়ে সে সশয় দ্ব্যর্থহীনভাবে যে বিশ্বাস ও আদর্শের কথা বলেছিলাম, তা থেকে আমি সরে যেতে পারিনি। হাততালির লোভে নিছক আবেগ-উত্তেজনায় লোক ঠকাতে কথা বলিনি এ বিশ্বাসে আমি অবিচল।
যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠিত হয়েছিলো- সে চেতনার মশাল নিঃশেষিত হয়নি এখনো। হুজুগের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যায়নি সবাই। হয়নি পথভ্রষ্ট। হীন ব্যক্তিচার্থ চরিতার্থ করার পঙ্কিল নর্দমায় সবাই ডুবে যায়নি। আজো পিসিপি’র সেই আদর্শের ধারা অক্ষুন্ন রেখে চলার মতো দৃঢ়তা ও সাহসিকতা সম্পন্ন তেজোদীপ্ত ছাত্র-যুবকের অস্তিত্ব রয়েছে। যুগে যুগে আদর্শিক তরুণরাই জাতয়ি সংকটময় দিনে এগিয়ে এসেছে। এক যুগপূর্তিতে তাই প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। এই আদর্শিক তরুণরাই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গৌরবোজ্জ্বল পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সামনে মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছে। শত বাধা-বিপত্তিতে তারা দমে যায়নি। নীতি-আদর্শ ও লক্ষের প্রশ্নে রয়েছে অবিচল, অটল ও আপোষহীন। লোভ-প্রলোভনের কাছে হয়নি পরাজিত। বিকিয়ে দিতে পারেনি নীতি-আদর্শ। প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির হুমকি ও রক্তচক্ষুতে স্তব্দ হয়নি। নির্যাতিত লাঞ্ছিত জনতার সপক্ষে কাজ করার যে শপথ নিয়েছিলো, তার সাথে তারা বেঈমানী করতে পারেনি।
পিসিপি’র গঠন ও অগ্রযাত্রা কখনোই সহজ সরল ছিলো না। গঠনলগ্ন থেকেই পিসিপি’কে বহু দৃশ্য-অদৃশ্য বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রগতিশীল শক্তিকে সামনে এগুতে হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কালো মেঘের মতো ছায়া ফেলে ব্যাঘাত ঘটালেও, তা কখনই চিরস্থায়ী হতে পারেনি। সূর্যকে মেঘ কখনই চিরদিনের জন্য ঢেকে রাখতে পারে না। সময় অবস্থা বিশেষে কখনো কখনো সাময়িকভাবে আড়াল করে রাখতে পারে মাত্র। দুনিয়ার সব দেশের আন্দোলন-সংগ্রামে তাই দেখা গেছে। পিসিপি’র আন্দোলন সংগ্রামেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বহু আঁক-বাক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এ সংগঠন। সামনে এগিয়ে যেতে অতীতে যেমন বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করতে হয়েছে, আজো করতে হচ্ছে। এক যুগপূর্তিতে পেছনে ফিরে তাকালে সেই দিনগুলো হয়ে উঠে জীবন্ত।
নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ প্রতিবাদঃ
‘৮৯ সালের ৪ মে লুঙুদুতে সংঘটিত হয়েছিলো হত্যাযজ্ঞ। তার প্রতিবাদ হয়েছিলো ২১ মে। দু’সপ্তাহের অধিক সময় পরে। ১৬ দিনের মাথায়। তা হয়েছিলো ঢাকায় রাজধানীতে। করা যায়নি পার্বত্য চট্টগ্রামে। সেদিন লুঙুদু হত্যাযজ্ঞের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হতে পারেনি। তার প্রধান অনেক কারণের মধ্যে ছিলো একটি বৃহত্তর সংগঠনের অনুপস্থিতি আর ছাত্র সমাজের বিচ্ছিন্ন অবস্থা। তার জন্য সময় লেগেছিলো ছাত্র সমাজকে সংগঠিত হতে।
বৃহত্তর একটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই জনগণের বুকে জমাট বাঁধা বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের ভাষা দিতে সক্ষম হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ ‘৮৯ এর ২১ মে। তদানিন্তন পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র সমাজকেও তাই করতে হয়েছিলো ‘৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে। তার সাথে সময়-কালের আর কিছু বিষয়ের পার্থক্য থাকলেও মর্মবস্তুতে এ প্রতিবাদেরও আছে সাযুজ্য। ‘৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ ছিলো জঙ্গী। অমান্য করেছিলো অন্যায় ১৪৪ ধারা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দিয়েছিলো আত্মাহুতি। তাদের আওয়াজ ছিলো বজ্র কণ্ঠ। শ্লোগানে রাজপথ ছিলো প্রকম্পিত। সারা পূর্ব পাকিস্তানে তার প্রভাব পড়েছিলো এবং তা ছিলো সুদূরপ্রসারী। ‘৮৯ এর ২১ মে পিসিপি’র প্রতিবাদ বাহ্যিকভাবে সে ধরনের ছিলো না বটে। কিন্তু অন্তর্গত দিক দিয়ে ছিলো একই। সেদিনের প্রতিবাদ হয়েছিলো বজ্র কণ্ঠ নয়, শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেও নয়। হয়েছিলো অহিংসপন্থায় শান্তিপূর্ণ শোক মিছিল। সে মিছিল ছিলো মৌন, কিন্তু চেতনায় ছিলো বিদ্রোহ। বুকে ছিলো প্রতিবাদের আগুনের ফুলকি। কিন্তু কণ্ঠে ছিলো তখনো জড়তা। বিক্ষোভ প্রকাশ করতে ছিলো আড়ষ্টতা। কিন্তু এই মিছিলের তাৎপর্যও ছিলো অনেক গভীর, অনেক সুদূরপ্রসারী। তার মধ্য দিয়ে এক যুগসন্ধিক্ষণে সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশটি রাজপথে বেরিয়ে আসে। সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর কান্নার মতো নিজের আবির্ভাব জানিয়ে দেয় দুনিয়াবাসীকে। অত্যাচারী শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে নামে রাজপথে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে ছিলো তা এক বিরাট যুগান্তকারী ঘটনা।
তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার-সেনাবাহিনীর পরিচালিত দমন-পীড়ন হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে কোথাও মিছিল হয়নি। সম্ভব ছিলো না পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কিছু করা। নিষিদ্ধ ছিলো সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ। খোদ ঢাকায় রাজধানীতে সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের শত শত পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ আর প্রতিবাদ। দেশের নাগরিক আর সাংবাদিকদের সাক্ষী রেখে এত বড় ঘটনা নিঃসন্দেহে পত্রিকার প্রথম পাতায় ব্যানার হেডিং’এ সংবাদ হবার মতো ছিলো। কিন্তু তা সেদিন দেশের কোন পত্রিকায় এক লাইন পর্যন্ত খবর হয়নি, হতে পারেনি। কেবল ভয়েস অব আমেরিকা আর আকাশ বাণী হতে সে খবরটি প্রচারিত হয়েছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংবাদ প্রকাশে সরকারীভাবে কী রকম কড়া সেন্সর আরোপ ছিলে তা তারই প্রমাণ।
সময়টা ছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের। ঢাকায রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক দিয়ে মাড়িয়ে দেবার বর্বরোচিত দৃষ্টান্ত ছিলো। মিছিল বের করা তখন এত সোজা ছিলো না। পার্বত্য চট্টগামের ছাত্র-ছাত্রীদের বেলায় তা ছিলো আরো কঠিন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজে পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছিলো তৎকালীন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ নেতৃবৃন্দ। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে কথা বলতে আমার ছিলো আড়ষ্টতা। নিঃসন্দেহে সেদিন আমার বক্তব্য নাড়া দেবার মতো ছিলো না।
যেভাবে গঠিত হলো পিসিপিঃ
বিভিন্ন মত পথের ছাত্রদের একটি মঞ্চে সমবেত হওয়া, একই পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সহজ ব্যাপার ছিলো না। এ সংগঠন এত সহজেও হয়নি। কোন কিছুই এর জন্য সাজানো গুছানো ছিলো না। সমস্ত কিছুই একে একে ঠিক করে নিতে হয়েছিলো। লুঙুদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানাতে প্রথম বৈঠক হয় ২০ মে বিকেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের [বুয়েট] রশীদ হলের ২০০২ রুমে। তার আগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের খবর দেয়া হয়েছিলো। সে মিটিঙ রাত পর্যন্ত গড়িয়েছিলো। ময়মনসিংহ আর রাজশাহীর বন্ধুরা তখনও মিটিঙে পৌঁছেনি। মিটিঙে বুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর মোহাম্মদপুর হোষ্টেলের বন্ধুরাই উপস্থিত ছিলেন। সে মিটিঙেই অনেক আলাপ আলোচনার পর গঠিত হয় আজকের ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’। সিদ্ধান্ত হয় তার পরের দিন ২১ মে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে শোক মিছিল হবে।
এখন হাস্যকর মনে হলেও এটা বাস্তব সত্য যে, সংগঠনের নামের সাথে সেদিন ‘উপজাতি’ শব্দটি রাখার প্র্রস্তাবও উত্থাপিত হয়েছিলো। বিরাগভাজন না হবার জন্য সরকারের পছন্দসই ‘উপজাতি’ শব্দটি মেনে নেবার কথাও বলেছিলো কেউ কেউ। সংগঠনটি নিষিদ্ধও হতে পারে সে আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছিলো। ছাত্র সমাজের করণীয় নির্ধারণ করার চাইতে সরকার কিভাবে ছাত্র সংগঠন ও প্রতিবাদকে বিবেচনা করবে তা নিয়ে ছিলো কারোর কারোর যত দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ! ‘উপজাতি’ শব্দের ব্যাপারে জোরালো আপত্তি উঠে, বিশেষত: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে সোচ্চার ছিলো। ‘উপজাতি’ ‘পাহাড়ি’ শব্দের পক্ষে-বিপক্ষে সেদিন যুক্তি উত্থাপিত হয়েছিলো। ‘জাতি’ ‘জাতিসত্তা’ এসব বিষয়েও কথা হয়। অবশেষে সবার সম্মতিতে ‘উপজাতি’ শব্দ বর্জন করে সংগঠনের নামের সাথে ‘পাহাড়ি’ কথাটিই গৃহীত হয়। চূড়ান্ত হয় সংগঠনের নাম ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’। তার সংক্ষেপে ‘পিসিপি’ তখনো চালু হয়নি। এটা হয়েছে আরো পরে। বলার সুবিধার্থে পত্র-পত্রিকায়ই সংক্ষেপ করে এ নাম দেয়া হয়েছিলো। পরে সেটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। চট্টগ্রামে আহুত সংগঠনের ৪র্থ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রের সংশোধনীর সাথে এ নাম অনুমোদিত হয়।
প্রতিষ্ঠালগ্নে ‘উপজাতি’ ও ‘পাহাড়ি’ এ দু’টি অভিধা নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছিলো, তা ছিলো আসলে তখনকার ছাত্রদের মাঝে বিরাজিত দু’টি ধারার বহিঃপ্রকাশ। শব্দগতভাবে ‘উপজাতি’ কথাটি প্রত্যাখ্যাত হলেও চিন্তা ও কাজের ধারা থেকে তা যে পুরোপুরি মুছে যায়নি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তারই সাক্ষ্য দেয়।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর পরই কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়নি। শুরুতে গঠনতন্ত্রতো ছিলোই না, ঘোষণাপত্রও প্রস্তুত হয়নি। কোন সংগঠনেরই তা আগাম প্রস্তুত থাকে না। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদেরও তা ছিলো না। পরে পর্যায়ক্রমে সবকিছু প্রস্তুত করা হয়েছে। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে একটি বৃহত্তর ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে পারাটাই সেদিন ছিলো বড় সাফল্য। প্রতিষ্ঠার পরেই এ সংগঠনের সবচে’ বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায় তারপরের দিন লুঙুদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে মৌন মিছিল সংগঠিত করা। তাই সংগঠন পরিচালনার বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সে সময় আলোচনা করার আর অবকাশ ছিলো না।
২১ মে তারপরের দিন মৌন মিছিল কিভাবে সফল হবে তা নিয়ে সবার গলদঘর্ম হবার দশা হয়। সেটা ছিলো নতুন। সে ব্যাপারে অভিজ্ঞতাও কম। ব্যানার, প্লেকার্ড এর ভাষা ক হবে, লুঙুদু হত্যাকান্ডকে জেনোসাইড বলা যাবে কিনা, লিফলেটে কী বিষয় আসবে এসব ঠিক করতেই সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার অবস্থা। বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রেস কনফারেন্স। প্রেস কনফারেন্সে কী কী বিষয় আসতে পারে তা নিয়েও বেশ আলোচনা হয়। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে তখনো ভয় ছিলো। ইতিপূর্বে কারোরই কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না। হত্যাকান্ডের মতো ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিক সম্মেলন করতেও সে সময় আমাদের আড়ষ্টতা ছিলো। অনেক কিছুতেই ছিলো জড়তা। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবে ছয় জন প্রতিনিধি। তাতে আহ্বায়ক হিসেবে থাকেন প্র্রশান্ত ত্রিপুরা। সদস্য হিসেবে ছিলেন: বিধান চাকমা, শুভাশীষ চাকমা, প্রসিত খীসা, ধীরাজ চাকমা (বাবলী) ও মং থোয়াই। এটিই ছিলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি। সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবার জন্যই তা ঠিক করা হয়। সেটি কার্যকরী কমিটি হিসেবে থাকবে কিনা তাও তাড়াহুড়োর কারণে আর ঠিক হয়ে উঠেনি। মিছিল শেষ হলে সবাই যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যায়। সে পর্যন্ত ছিলো প্রথম আহ্বায়ক কমিটির কার্যক্রম। পরবর্তীতে সে কমিটির আহ্বানে কোন মিটিংও আর হয়নি।
সেদিনের আহ্বায়ক কমিটির প্রশান্ত দা এখন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে শিক্ষকতা করছেন। আমেরিকায় পড়তেন, সে সময় দেশে ছিলেন। লুঙুদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রশীদ হলে ২০০২’এ যে মিটিং হয় ঘটনাচক্রে তিনিও সেদিন ঢাকা এসে পৌঁছেন। খাগড়াছড়িতে এক সেনা কর্মকর্তার সাথে তার বাকবিতন্ডাও হয়েছিলো একটি ঘটনা নিয়ে। শক্তি’র [শক্তিপদ ত্রিপুরা] কাছ থেকে আমরা তার ঢাকায় আসার কথা জানতে পারি। তাকে মিটিঙে পাওয়াতে আমাদেরও জোর বাড়ে। বিধান চাকমা সে সময় বুয়েটের সিনিয়র ছাত্র, এখন আমেরিকায় প্রবাসী। শুভাশীষ চাকমা সে সময় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র, কঠিন অসুখে ভূগে অকালে তার জীবনাবসান হয়। ধীরাজ চাকমা (বাবলী) তখন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে কর্মরত। মং থোয়াই তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এখন গ্রিন হিল এনজিও’র সাথে সম্পৃক্ত। আর নিবন্ধকার নিজে এখন ইউপিডিএফ’র সাথে জড়িত।
প্রথম দিকে পিসিপিঃ
বৃহত্তর সংগঠন পিসিপি শুরুর দিকে ছিলো অনেকটা জোটের মতো। বিভিন্ন শিক্ষা প্র্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংগঠনগুলো একই প্লাটফরমে সমবেত হয়েই পিসিপি গঠিত হয়েছিলো। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলো বিলুপ্ত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের স্বার্থ তুলে ধরার প্রবণতা ছিলো। বৃহত্তর সংগঠনের চেতনাবোধ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে কিছু দিন লেগে যায়। পিসিপি’র প্রথম কেন্দ্রীয় মিটিঙে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত হয়। এ মিটিঙেই চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ, ঢাকা ট্রাইবাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন ও রাজশাহী হিল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন [হিসরু] বিলুপ্ত হয়ে পিসিপি’তে লীন হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ময়মনসিংহে তখনো ছাত্র সংগঠন হয়নি। কুমিল্লায় চিসকো [কুমিল্লা হিল স্টুডেন্টস্ অর্গানাইজেশন] নামে সংগঠন ছিলো। বিভিন্ন কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র সংগঠন না থাকলেও, সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। মিটিঙে কলেজ পর্যায়ে যে সব সংগঠন ক্রিয়াশীল ছিলো সে সব সংগঠনগুলোও বিলুপ্ত বলে ধরা হয়। যদিও তাদের সব প্রতিনিধি ঐ মিটিঙে ছিলেন না। বৃহত্তর ঐক্যবোধ হয়ে উঠেছিলো প্রবল।
প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি ও দপ্তরঃ
পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটি গঠনের লক্ষে পিসিপি’র প্রথম মিটিঙ হয় বুয়েট ক্যাফেটরিয়ায়। সে মিটিঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিআইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর হোষ্টেল হতে প্রতিনিধিরা ছিলেন। যেহেতু জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা। সে কারণে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় দপ্তর ঢাকায় হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বুয়েটের রশীদ হলের ২০০২ রুমটিতে স্থাপিত হয় পিসিপি’র কেন্দ্রীয় প্রথম কেন্দ্রীয় দপ্তর।
সবদিক বিবেচনা করে কাজের সুবিধার্থে প্রথম কেন্দ্রীয় কমটিতে তুলনামূলকভাবে ঢাকায় অবস্থানরত ছাত্রদের সংখ্যা বেশী রাখার ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত হয়। সে বৈঠকেই ১৭ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে ঢাকাস্থ ছাত্রদের মধ্য হতে ৬ জন [জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১জন সহ ], চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ৬ জন, রাজশাহী হতে ৩ জন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২ জন রাখা হয়। কাজের সুবিধার্থে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো ঢাকাস্থ ছাত্রদের উপর ন্যস্ত হয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো পদও একই কারণে ঢাকায় অবস্থানরত ছাত্রদের নেয়া উচিত বলে ঐক্যমত হয়। টেকনিক্যাল লাইনের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ঐ দু’টো পদ বুয়েটের ছাত্রদের নিতে হয়। বুয়েটই তখন হয়ে উঠে পিসিপি’র যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্র সংখ্যা নগন্য। জগন্নাথ হল থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাবার মতো অবস্থা পর্যন্ত ছিলো না।
কিন্তু ক্রমেই সংগঠনকে জাতীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর কাতারে নিয়ে যাবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক করার প্রচেষ্টা চলে। পিসিপি’র দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলে কেন্দ্রীয় দপ্তর রশীদ হল থেকে জগন্নাথ হলের ৩২০ পূর্ববাড়ীতে স্থানান্তর করা হয়। তৃতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি হলে দপ্তর জগন্নাথ হলের ৩২০ নাম্বার রুম হতে অক্টোবর স্মৃতিভবনের ৪৭০ রুমে স্থানান্তর করা হয়। প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন পর্যন্ত পিসিপি’র গঠনতন্ত্র ছিলো না। প্রথম মিটিঙে গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পিত হয় প্রসিত খীসা, করুণাময় চাকমা ও ধীরাজ চাকমার উপর। রশীদ হলের ২০০২’এ পিসিপি’র গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হয়েছিলো। ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত হয়েছিলো আরো পরে। ৭ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে তা অনুমোদিত হয়েছিলো। পতাকা ডিজাইন করে প্রবীন খীসা তাতু। পিসিপি’র দলীয় সঙ্গীত নতুন রচিত হয়নি। সুগত চাকমার (ননাধন) রচিত গান প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বাজানো হয়, তার পর থেকেই সেটি দলীয় সঙ্গীত হিসেবে চালু হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পূর্ব ঘটনাক্রমঃ শুরুর আগে শুরু
পিসিপি প্রতিষ্ঠার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো ছিলো নিষিদ্ধ। সেনা ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজর ছিলো তীক্ষ্ণ। ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের ছিলো তাদের তৎপরতা। ছাত্র ও যুবকরা ছিলো সবচে’ টার্গেট। দিন দিন নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা সীমা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে থাকে। নির্বিচারে খুন-গুম হয়ে উঠে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঘরে বাইরে কোথাও ছিলো না সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা। প্রতিটি রাত ছিলো আতঙ্ক ও অনিশ্চিতে ভরা। নিজের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়ে অর্ধলক্ষাধিক লোক ছিলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী। আরো হাজার হাজার ছিলো বাস্তুহারা। পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিলো দিন দিন অসহনীয় শ্বাসরুদ্ধকর। পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই দুর্দিনে জনগণের ভাব-ভাবনার ভাষা দেবার মতো বাইরে ছিলো না কোন সংগঠন। ছাত্র সংগঠনগুলো তখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক, তাদের ছিলো সীমাবদ্ধতা। সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত জনসংহতি সমিতি ছিলো রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা। জাতীয় জীবনে বিরাজ করছিলো এক বিরাট শূণ্যতা।
এই জাতীয় সংকটময় সময়ে জনগণের ভাব ও ভাবনার ভাষা দিতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো একটি ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর ছাত্র সংগঠনের এবং অচলায়তন ভাঙতে এক ছাত্র জাগরণের। সমাজের সবচে’ সচেতন সংবেদনশীল ও প্রতিবাদী অংশ হিসেবে রাজনৈতিক মঞ্চে ছাত্র সমাজের আবির্ভাব ছিলো সময়ের দাবি। এবং তা ছিলো অনিবার্য। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানানোর অবস্থাও ছিলো না। নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে সংগঠন গড়ে তুলে আন্দোলন করা যেতো না। স্বাভাবিকভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রকাশের পন্থা হয়ে উঠে গোপন তৎপরতা। প্রতিবাদের মাধ্য হয়ে উঠে গোপন প্রচারপত্র। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানো না গেলেও শিক্ষা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের আড়ালে সে সময় রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারিত হতে থাকে ছাত্র যুবকদের মধ্যে। রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর প্রায়স সূক্ষ্মভাবে চালু ছিলো। ক্রমেই ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ বারুদের মতো স্তুপীকৃত হতে থাকে। বিস্ফোরিত হবার অপেক্ষায় ছিলো তা। এ সময় ‘৮৯ সালে লংগুদু হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলে, ছাত্র-সমাজের এতদিনের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি বৃহত্তর সংগঠন পিসিপি’র।
একদিনে কেবল একটি ঘটনায় হঠাৎ করে পিসিপি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে গঠনের পেছনে আছে প্রেক্ষাপট। আছে ঘটনার পিছে ঘটনা। দৃশ্যপটের অন্তরালে সংঘটিত হয় বহু ঘটনা। একটি বৃহত্তর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে ও আন্দোলন জোরদার করতে বাধা ছিলো সবদিক থেকে। বাধা কেবল বাইর থেকে ছিলো না, ছিলো ভেতর থেকেও। বাইর থেকে সরকারের কড়া বিধি নিষেধ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা যেমন ছিলো প্রবল। ভিতরে তেমনি ছিলো ছাত্র সমাজের অন্তর্গত দুর্বলতা। প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী মানসিকতা ছাত্র সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিলো। একটি বৃহত্তর সংগঠন প্রতিষ্ঠার এতো সময় নেবার পেছনে ছিলো এটিও একটি বড় কারণ।
সরকার সেনা গোয়েন্দাচক্রের শত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ছাত্র সমাজের মধ্যকার সংগ্রামী প্রতিবাদী ধারাটি নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে। ব্যাপক ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করে। অন্য দিকে প্রতিকিয়াশীল সুবিধাবাদী গোষ্ঠিটি জাতীয় দুঃসময়ে সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিতে সরকার-সেনাবাহিনীর কোলে উঠে যায়। বৃহত্তর ঐক্য ও ছাত্র জনগরণ ঠেকাতে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলন দমন করতে মোনেম খাঁন যে উদ্দেশ্যে এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস্ ফেডারেশন) সৃষ্টি করেছিলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা গোয়েন্দা চক্রও তাই করে। সকল বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে ছাত্র সমাজের কার্যক্রম চলতে থাকে। একটি বৃহত্তর সংগঠন গড়ার লক্ষে খন্ড খন্ড প্রচেষ্টা যুক্ত হতে থাকে। ঘটনার পর ঘটনা মিলে ক্রমেই তা একটি পরিণতির দিকে এগুচ্ছিল। একটি বৃহত্তর সংগঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সে সময়কার বিভিন্ন উদ্যোগ ছাত্র আন্দোলনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। সে সময়কার বিভিন্ন খন্ডিত প্রচেষ্টার যৌক্তিক পরিণতিই হচ্ছে আজকের ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠনের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে যে সব উদ্যোগ গৃহীত হয়, যে ঘটনা, প্রচেষ্টা ও কার্যক্রম ছাত্র আন্দোলনে গভীর ছাপ ফেলে, একটি বৃহত্তর সংগঠনের আবির্ভাবকে সম্ভব করে তোলে এবং যা আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করেছিলো, সে সবের প্রধান প্রধান উল্লেখযোগ্য দিকগুলো সময়াক্রম অনুসারে এখানে বুঝার সুবিধার্থে তুলে ধরা হলোঃ
* পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন নির্যাতনের ঘটনাবলী লেখালিখির মাধ্যমে তুলে ধরতে ‘৮৬ সালের ১৬ নভেম্বর জন্ম নেয় একটি ভিন্নধর্মী সংগঠন ‘হিল লিটারেচার ফোরাম’। প্রকাশ করা হয় তার অনিয়মিত প্রকাশনা ‘রাডার’ দেয়ালিকা। অত্যন্ত সীমিত পরিসরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে এতে লেখালিখি হতে থাকে। যদিও তা কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু এ উদ্যোগ ছিলো তখনকার অশান্ত পরিস্থিতিতে ছাত্র সমাজের বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। পরবর্তীতে এ ‘রাডার’ প্রকাশনা সেনাবাহিনীর অপকর্ম দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে সাড়া জাগিয়েছিলো এবং নিষিদ্ধ তা হয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হিল লিটারেচার ফোরাম ও রাডার প্রকাশনার সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিলো।
[দেখুনঃ রাডার, রাহুমুক্তি সংখ্যা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ ]
* বৃহত্তর ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ : ‘৮৭ সালের ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন ‘চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ’ বৃহত্তর সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষে উদ্যোগ নেয়। ঢাকা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহের ছাত্র সংগঠন ও অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষে সম্মত হয়। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান কলেজের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ প্রতিনিধিদের সাথেও এ সংগঠন যোগাযোগ করে। [দেখুন : পঞ্চম বার্ষিক প্রতিবেদন, চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ; সংগঠনের সংকলনঃ স্যালভো-প্রকাশনা, ৫ মে, ১৯৯৮; পৃষ্ঠা-২৪]। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক হলেও এ সংগঠন বৃহত্তর চট্টগ্রামে অধ্যয়নরত ছাত্রদের সাথে সংযোগ রক্ষা করে কার্যক্রম চালাতো। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে বৃহত্তর সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা তখন বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকা ট্রাইবাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নও এক সময় নিজেদের ধাঁচে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু ছাত্র সমাজকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।
* ১২ এপ্রিল, ১৯৮৭ : পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবী উপলক্ষে শুভেচ্ছাপত্র প্রকাশ করে ‘চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ’ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রিত অর্ধলক্ষাধিক জুম্মো শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে এ সংগঠন প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়।
* ২৪ জুন, ১৯৮৭ : এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন রাঙ্গুনিয়া ও গহিরা কলেজ হতে ৩ জন ছাত্রীসহ ১২ জন পরীক্ষার্থীকে পুলিশ আটক করলে চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বিচার ধরপাকড়ের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। একটি প্রচারপত্রও সংগঠনের নামে ছাড়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার-সেনাবাহিনীর পরিচালিত দমন-পীড়নের প্রকাশ্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতে অনেকের দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক একটি সংগঠনের নামে প্রকাশ্যে সরকার-সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে ভয়-ভীতি কাজ করতো। এ সময়ে ‘বৃহত্তর পাহাড়ী ছাত্র ঐক্য’ নামে সরকার-সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে প্রচারপত্র ছাড়া হয়। যদিও সে নামে কোন সংগঠন তখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি, সে ধরনের একটি বৃহত্তর সংগঠন যে ছাত্র সমাজ মনে প্রাণে চাইছিলো–সেটা তারই প্রতিধ্বনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতেই সে সময়ে ‘বৃহত্তর পাহাড়ী ছাত্র ঐক্য নামে প্রচারপত্র বিলি হয়েছিলো।
* ‘৮৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম বারের মতো ‘পার্বত্য ছাত্র ও যুব সংহতি সংঘ’ গোপন সংগঠনের নামে এক লিফলেট প্রচারিত হয়। তাতে সরকার-সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো হয়। তার আগে ‘৮৭ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পুজগাঙ ইউপি কার্যালয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের ২য় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তার পরে পরেই গোপন প্রচারপত্রের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে চলমান বৈঠক ও সেনাবাহিনীর দোমুখী কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয়। সে সময় ঐ প্রচারপত্র ছাত্র সমাজকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে।
* ‘৮৮ সালের ৮ -১০ আগস্ট বাঘাইছড়ির হিরাচর-সার্বোতলী-পাবলাখালীতে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলে তার প্রতিবাদে ‘জুম্ম স্টুডেন্টস্ ফ্রন্ট’ নামে প্রচারপত্র ছাপা হয়। প্রচারপত্রে জনসংহতি সমিতির সাথে বৈঠক চলা অবস্থায়, সরকারের মনোনীত লোক নিয়ে আলাদাভাবে বৈঠক প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয়। তখনো ঐ নামে কোন সংগঠন ঢাকায় গঠিত হয়নি। ঢাকায় সে সময় ‘ঢাকা ট্রাইবাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের’ অস্তিত্ব থাকলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত এ সংগঠনটি কোন বক্তব্য দেয়নি। ঢাকাস্থ ছাত্র ও যুবকদের ক’জন অগ্রণীই ‘জুম্ম স্টুডেন্টস্ ফ্রন্ট’ নাম দিয়ে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে এক প্রচারপত্র ছেপেছিলেন। এ ধরনের তৎপরতার মধ্য দিয়ে তখন ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিছিলো এবং একটি বৃহত্তর সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তোলার আকাঙ্খা প্রবল হয়ে উঠেছিলো।
* ‘৮৮ সালের নভেম্বরের প্রথমার্ধে চট্টগ্রাম শহরের এক প্রেস হতে লিফলেট আনতে গেলে সেনা গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে রাঙ্গামাটি কলেজের ছাত্র হেমল দেওয়ান, চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জ্ঞান প্রকাশ খীসা ও চিজিমণি চাকমা দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। তাদেরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের নির্যাতন শিবিরে আটকে রাখা হয়। এ ঘটনা ছাত্রদের আন্দোলিত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতিতে এ ধরনের তৎপরতা ছিলো ছাত্র সমাজের মধ্যকার প্রতিবাদী ধরাটির সংগ্রামী চেতনা, সাহসিকতা ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এগিয়ে যেতে পারার বলিষ্ট প্রকাশ। এ ঘটনার জের ধরে ছাত্রদের তৎপরতা স্তব্দ করে দিতে রাঙ্গামাটিতে ধরপাকড় শুরু হয়ে যায়। বেশ ক’জন ছাত্র আটক হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমের উপর সেনা গোয়েন্দাদের নজরদারি বেড়ে যায় এবং তারা হয়ে উঠে সাংঘাতিক তৎপর। রাঙ্গামাটি কলেজে তখন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কিছু প্রতিবাদী ছাত্র সবে কার্যক্রম শুরু করেছিলো। তারাই কলেজে সমাজ পরিবর্তনের শ্লোগান দেয় এবং বেশ কিছু ছাত্রকে আকৃষ্ট করে। তাদের তৎপরতার মুখে সে সময় ‘রাঙ্গামাটি ট্রাইবাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন’ কার্যত: অচল হয়ে পড়ে। এ সময় রাঙ্গামাটি কলেজে বিপ্লবী রাজনীতির ছোঁয়া লাগে। ‘৮৮ সালের নভেম্বরে ধরপাকড়ের পর রাঙ্গামাটিতে জাতীয় ছাত্র দলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
* ‘৮৮ সালের শেষ দিকে খাগড়াছড়ি কলেজ ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গোপনে পোষ্টারিং হয়। সরকার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদই ছিলো পোষ্টারের বিষয়বস্তু। এতে সরকার-সেনাবাহিনীর টনক নড়ে। নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা যতই তীব্র হয়ে উঠেছিলো, তার পাল্লা দিয়ে ছাত্র যুবকদের মধ্যে প্রতিবাদ স্পৃহাও বেড়ে যাচ্ছিল। ঐ পোষ্টারিং’এর ব্যাপারে কোন ধরনের রহস্য উদ্ধার করতে না পেরে সেনা গোয়েন্দারা অন্যায়ভাবে খাগড়াছড়ি কলেজের নাইট গার্ডকে (পাহাড়ি) উক্ত ঘটনার জন্য শারিরীকভাবে সাংঘাতিক নির্যাতন করে, তাকে দীর্ঘদিন অন্যায়ভাবে জেলে অন্তরীণ রাখে।
সেনা গোয়েন্দাদের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে সে সময় গোপনে সরকার বিরোধী তৎপরতা ছিলো।
সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের জড়ো করে সেনাবাহিনী ‘খাগড়াছড়ি জেলা জনকল্যান সমিতি’ নামের সংগঠন খাড়া করে দিলে, তার প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার প্রকাশের প্রতীক হিসেবে সেনা গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে ঐ দালাল সমিতির সাইনবোর্ড কাদা মাটি লেপে দেয়া হয়। এতে সেনা কর্মকর্তারা জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়। কাদা মাটি লেপে দেয়া সাইনবোর্ড দেখতে লোকজন জড়ো হয়, এবং হাসির রোল পড়ে যায়। উক্ত ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সে সময় খাগড়াছড়ির কুখ্যাত ব্রিগেড কমান্ডার ইব্রাহিম মন্তব্য করতে বাধ্য হন যে, সাইনবোর্ড নয়, ঐ কাদা মাটি তার মুখেই লেপে দেয়া হয়েছে।
সরকার সেনাবাহিনী যতই ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করে আন্দোলন দমনের অপচেষ্টা চালাচ্ছিল, তার বিপরীতে নানাভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভও হচ্ছিল। সরকার সেনাবাহিনীর বাজনার তালে সবাই যে নির্লজ্জভাবে নাচানাচি করতে প্রস্তুত নয়, আর সেনাবাহিনীর অপকর্ম তাচ্ছিল্য করার মতো সাহসী যুবকের অস্তিত্ব যে তখন ছিলো তা তারই বহিঃপ্রকাশ।
* ‘৮৯ সালের ২৫ জুন তথাকথিত স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন ঘনিয়ে আসে। যে কোন প্রকারে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সরকার সেনাবাহিনী পরিকল্পনা নেয়। ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে যে প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছিল, তা স্তব্দ করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠে সেনা গোয়েন্দা চক্র। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কাছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ছাত্রের সংখ্যাও বেশী ছিলো। সে সময়ে বলতে গেলে সবদিক দিয়ে তৎপর ছিলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও ছিলো। এখান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলীর প্রতিবাদ হতো। সে সময় প্রকাশ্য জনসমাবেশে খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। হুঁশিয়ারী দেন ভয়াবহ পরিণতির। তখনকার সংগঠনের সভাপতিকে ডেকে নিয়ে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে পত্রিকায় বিবৃতি দিতে বাধ্য করেন। একভাবে অবরুদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন। তাতেও সেনা গোয়েন্দা চক্র নিশ্চিন্ত হতে পারছিলো না।
‘৮৯ সালের ২৪ মার্চ সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ায় আহুত মিটিঙে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে সেনা মদদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তৎকালীন ‘চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদের’ ফাইল কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়। কয়েকজনকে শারিরীকভাবেও জখম করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনের প্রকাশ্য কার্যক্রম পুরোপুরি অচল করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র আন্দোলনে ঐ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করে। প্রতিবাদী ধারাকে স্তব্দ করে দিতে সেনা-গোয়েন্দা চক্র ঠিক সেটাই চেয়েছিলো। জুম্মো দিয়ে জুম্মোদের ঠেকিয়ে রাখাই ছিলো তাদের পলিশি। জেলা পরিষদের নির্বাচনের আগে সেনা গোয়েন্দাচক্র প্রতিবাদের সমস্ত Prospective Elements স্তব্দ করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ বিক্ষোভকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের বাহ্যিক কার্যক্রম সেনা গোয়েন্দা চক্র বন্ধ করে দিতে সক্ষম হলেও গোটা ছাত্র সমাজকে তারা স্তব্দ করে দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনা গোয়েন্দা চক্রের হামলা প্রতিবাদী ছাত্র সমাজকে আরো বেশী বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সরকার সেনাবাহিনীর অব্যাহত ষড়যন্ত্র চক্রান্তের বিপরীতে ছাত্র সমাজ বিদ্রোহে ফুঁসতে থাকে। পরবর্তী কার্যক্রম তাই প্রমাণ করে।
* ‘৮৯ এর এপ্রিল ফুল বিঝু’র দিনে ‘পার্বত্য ছাত্র-যুব সংঘ’ গোপন সংগঠনের নামে জেলা পরিষদ ব্যবস্থা ও সেনা তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করে এক বুকলেট প্রকাশিত হয়। ঐ বুকলেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেটি ছিলো জাতীয় দুর্দিনে ছাত্র-যুব-জনতার মনে সাহস সঞ্চারকারী সবচে’ সাহসী বলিষ্ট ও বিশ্লেষণমূলক বুকলেট। ফুল বিঝুর আগের দিন রাতে সেনা গোয়েন্দাচক্রের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে তেজোদীপ্ত ছাত্র যুবকরা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সদরে ঘরে ঘরে এ বুকলেট পৌঁছে দেয়। পরেরদিন সকালে ফুল বিঝুর দিনে সবাই বুকলেট পেয়ে যায়। নিশ্ছিদ্র সেনা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও সে সাহসী তৎপরতা সবাইকে করে চমকিত। ছাত্র ও যুব সমাজকে করে উদ্দীপ্ত।
এত সরকার সেনা উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রীতিমত ঘাবড়ে যায়। ছাত্র-যুব সমাজের অব্যাহত তৎপরতা ও সাহসিকতায় বিচলিত হয়ে পড়ে সেনা কর্তৃপক্ষ। খাগড়াছড়ি হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত সরকারী সমাবেশে তখনকার চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ঐ বুকলেটের তীব্র সমালোচনা করেন। সে সংবাদ বিটিভিতে প্রচারিত হয়। দৈনিক ইত্তেফাকসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সেনা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছাপা হয়। তারা বড় ধরনের ছাত্র যুব আন্দোলনের আশঙ্কায় রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছাত্র ও জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে তার পরে পরেই সেনা কর্তৃপক্ষ ঐ বুকলেটের অনুকরণে সরকার ও সেনাবাহিনীর গুণগান গেয়ে পাল্টা বুকলেট ছাপে। রাঙ্গামাটি কলেজ ও খাগড়াছড়িতে সেনা এজেন্ট তা দিয়ে ছড়িয়ে দেয়। সরকার সেনাবাহিনীর সাথে ছাত্র যুবসমাজের প্রচারণা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইতিপূর্বেও সেনা গোয়েন্দাচক্র বেনামে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে গালিগালাজপূর্ণ (তোদের বাপ-মায়েরা নামে) নিম্নমানের প্রচারপত্র ছেড়ে দেয়।
শত বাধা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ছাত্র যুবকদের মধ্য হতে প্রতিবাদ উঠতে থাকে। জনসংহতি সমিতি সরকার সেনাবাহিনীর প্রোপাগান্ডার জবাব দিতে ব্যর্থ হলেও, ছাত্র যুবসমাজ সরকার সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করে দিয়ে সরকারের সাথে অদৃশ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই ফ্রন্ট ছিলো সরকার সেনাবাহিনীর ভীতি ও আতঙ্কের কারণ।
পরিস্থিতি যতই অবনতি ঘটছিলো, ততই প্রতিবাদ স্পৃহাও ছাত্র যুবকদের মনে প্রবলতর হয়ে উঠছিলো।
একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য সংকট বা বস্তুগত শর্ত (Objective Cause) ) হয়ে উঠছিলো পূর্ণ, দরকার ছিলো চেতনা বা বৈষয়িক শর্ত (Subjective Cause)। পরিস্থিতি ক্রমেই একটি পরিণতির দিকে এগুতে থাকে।
* ঘনিয়ে আসে ‘৮৯ সালের ৪ মে। এ দিন লংগুদুতে সংঘটিত হয় হত্যাযজ্ঞ। রাঙ্গামাটিতে প্রথম তার প্রতিক্রিয়া হয়। ৮ মে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে একত্রিত হন। ১০ মে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। ১১ মে রাঙ্গামাটির টাউন হলে তখনকার চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি সালাম ও রাঙ্গামাটির ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাফাত চিরাচরিত নিয়মে ধমক দিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের কাছে ঘটনার উল্টো ব্যাখ্যা দিতে চাইলে সেখানে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। কিন্তু তা কেবল রাঙ্গামাটি সদরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। তার বাইরে বেশী কিছু করার অবস্থাও ছিলো না তাদের। রাঙ্গামাটিতে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন আগেই স্তব্দ করে দেয়া হয়। তখনকার পরিস্থিতিতে জনসংহতি সমিতিও কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। জাতীয়ভাবে বিরাজ করছিলো এক সংকটময় পরিস্থতি। এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে সবাই ছাত্র সমাজকে প্রতিবাদী ভূমিকায় দেখতে চাচ্ছিলেন। ঘটনার প্রতিবাদ করতে রাঙ্গামাটিতে অনেক স্বতস্ফুর্তভাবে ছাত্রদের চাঁদাও তুলে দিয়েছিলেন। সময়ের দাবিতে সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রতিবাদী ও সচেতন অংশ হিসেবে ছাত্র সমাজের এগিয়ে আসা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনের জন্য একে একে সকল শর্ত পূর্ণ হয়ে উঠে। ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। বিভিন্ন সময়ে প্রচারপত্রের মাধ্যমে বৃহত্তর ছত্র ঐক্য ও ছাত্র জাগরণের আহ্বান জানানো হয়েছিলো। সরকার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন নির্যাতনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ ঐক্যের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। কেবল দরকার ছিলে একটি আহ্বানের। সর্বত্রই ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী ভূমিকা ও একটি বৃহত্তর ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশী তীব্রভাবে অনুভূত হয়।
লংগুদু হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে রাঙ্গামাটি শহরের প্রতিক্রিয়া জানাতে সে সময়ে তড়িঘড়ি করে প্রদীপ চাকমা [তখন চ.বি’তে সমাজতত্ত্বের ছাত্র] চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসে এবং ঘটনা অবহিত করে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ছাত্র সমাজের করণীয় নিয়ে প্রথম বৈঠক হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তা হয় গোপনে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আগেই ২৪ মার্চ সেনা গোয়েন্দাচক্রের মদদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি হামলা চালিয়ে সংগঠনের ফাইল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনকে অচল করে দিয়ে রাখে। সরকার সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার জন্য গোপনীয়তা বজায় রাখতে হচ্ছিল। সে বৈঠকে সীমিত ক’জন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে লংগুদু হত্যাযজ্ঞ, দেশের পরিস্থিতি ও ছাত্র সমাজের করণীয় নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয়। যে করেই হোক ঘটনার প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানানোর ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ধারার বন্ধুরা সবাই একমত হন। হত্যাযজ্ঞের প্রকাশ্য প্রতিবাদ ঢাকাতেই হওয়া উচিত সেটাও ঠিক হয়। সব কিছুই হচ্ছিল গোপনে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়া ও বার্তা নিয়ে ঢাকায় প্রতিনিধি পাঠানো জরুরী হয়ে পড়ে। আলাপ আলোচনার পর ঠিক হয় অগ্রবর্তী টিম হিসেবে দু’জন প্রতিনিধি প্রসিত খীসা ও প্রদীপ চাকমা ঢাকায় যাবেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের [বুয়েট] রশীদ হলে থাকতেন ধীরাজ চাকমা [বাবলী]। তার ২০০২ নাম্বার রুমেই তারা উঠেন এবং ঢাকাস্থ ছাত্রদের কাছে ঘটনাবলী তুলে ধরেন। ধীরাজ চাকমার রুম হয় যোগাযোগের প্রথম ঠিকানা। সেখান থেকেই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বন্ধুদের কাছে খবর পৌঁছানো হয়। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্ররা সে সময় ছিলেন ক্ষুব্ধ। সরকার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদে রাজপথে বেরিয়ে আসতে ছিলেন উম্মুখ। সবার মধ্যে তাড়না ছিলো বৃহত্তর ঐক্যের। সে ধরনের পরিস্থিতিতে সবাই এমনি একটি আহ্বানের প্রতীক্ষায় ছিলেন। স্বতস্ফুর্তভাবে সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০ মে মিটিঙে ছাত্র প্রতিনিধিরা সমবেত হন। একটি বৃহত্তর সংগঠন প্রতিষ্ঠার পথে বিভিন্ন সময়ের ঘটনাবলীর স্রোত খন্ড খন্ড প্রচেষ্টা এভাবেই ঝর্ণার মতো একই মোহনায় এসে মিলিত হয়। গঠিত হয় পিসিপি। বহু জনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা পরিশ্রমের যোগফল হচ্ছে আজকের এই বৃহত্তর সংগঠন।
পিসিপি প্রতিষ্ঠিত হবার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আর আগের মতো থাকেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যে প্রান্তেই অন্যায় অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে, সেখানে ছুটে গিয়েছে পিসিপি। নির্যাতিত দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংঘটিত করেছে। বাকরুদ্ধ জনতার কণ্ঠে পিসিপি ফিরিয়ে এনেছে প্রতিবাদের আওয়াজ। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ছাত্র সমাজকে করেছে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত। ছাত্র সমাজে ফিরিয়ে এনেছে মনোবল, আত্মবিশ্বাস আর সাহস। এতকালের জড়াগ্রস্থ ছাত্র সমাজকে করেছে চাঙ্গা। সংগ্রামী চেতনাকে করেছে আরো শাণিত। অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এনেছে নতুন জোয়ার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজের গর্ব করার মতো যদি কোন দিন থেকে থাকে, তারত মধ্যে নিঃসেন্দেহে ২৮ এপ্রিল ‘৯২ এর লোগাঙ লঙ মার্চ একটি দিন। শত শত ছাত্র সেদিন খর রৌদ্রে লোগাঙ ছুটে যায়। হত্যাযজ্ঞস্থল লোগাঙ পোড়া ভিটায় অস্থায়ী স্মৃতি সৌধ তৈরি করে। সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানায়। অজানা শহীদদের ধর্মীয় বিধান মতে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে দেয়। যে সময় লোগাঙ লঙ মার্চ হয়, তখন যুদ্ধবিরতি ছিলো না। রাস্তায় ছিলো সেনা চেক পোষ্ট ও টহল। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সেদিন সেনাবাহিনীর তাক করা রাইফেল সাব-মেশিনগান উদ্যত রক্ত চক্ষু কোন কিছুই প্রতিবাদী ছাত্র সমাজকে স্তব্দ করে দিতে পারেনি। পিসিপি’র সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
‘৯২ এর ২০ মে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আরো একটি স্মরণীয় দিন। এ দিন রাঙ্গামাটিতে পিসিপি’র তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় স্বায়ত্তশাসনের ডাক দেয়া হয়। তাতে সরকার সেনাচক্রের হৃদকম্পন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ভাড়াটে লোক দিয়ে তারা পিসিপি’র অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। সমবেত ছাত্র সমাজ গর্জে উঠে। ষড়যন্ত্রকারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে তুমুল বাকবিতন্ডা হয়। সেদিন রাঙ্গামাটি শহরে ছাত্র-জনতা অভূতপূর্বভাবে একাত্ম হয়ে যায়। পিসিপি’র কর্মিরা আত্মরক্ষার্থে হামলাকারীরা বনরূপা পুড়িয়ে দেয়। রাঙ্গামাটি শহর জ্বলে উঠে। তিন দিন ১৪৪ ধারা জারি থাকে। রাজবাড়ীতে পিসিপি’র শত শত নেতা-কর্মি আশ্রয় নেয়। সর্বস্তরের লোক পিসিপি’র পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘৯৪ এর ১০ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়িতে পিসিপি অন্যায় ১৪৪ ধারা অমান্য করে সফলভাবে অবরোধ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে। আন্দোলন সংগ্রামে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়। আন্দোলনে ঘটনাবহুল দিন বাড়তে থাকে। এ তালিকা এখানো শেষ নয়। পিসিপি’র উত্তাল সংগ্রামের এই দিনগুলো থাকবে চির অম্লান।
————-
[এই লেখাটি পিসিপি’র একযুগপূর্তি স্মরণিকা “আমি বিদ্রোহী” থেকে]