ঢাকায় বৈ-সা-বি উত্তর শুভেচ্ছা বিনিময় সভায় ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ
নিজস্ব প্রতিনিধি।। ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি উত্তর শুভেচ্ছা বিনিময় সভায় দেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দগণ বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংকট চলছে। যুগ যুগ ধরে সেনাশাসন বজায় রেখে অপারেশন উত্তরণের নামে সেখানকার পাহাড়ি জনগণের ওপর শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এই সমস্যা শুধু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নয়, এই সমস্যা আমাদের সকলের। পাহাড়ের এই সংকট উত্তরণের জন্য পাহাড়-সমতলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে”।
গতকাল শুক্রবার (২২ এপ্রিল ২০২২) ঢাকায় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এই শুভেচ্ছা বিনিময় সভার আয়োজন করে।
সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের কাছে বৈ-সা-বি’র গুরুত্ব তুলে ধরে পিসিপি’র সভাপতি সুনয়ন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসত্তাসমূহের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘বৈসাবি’ নামটি উৎপত্তি হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্র-যুবকরা ঐক্য গড়ার লক্ষে অনুষ্ঠান করে এবং রাঙামাটিতে বৈসাবি নাম দিয়ে একটি সংকলন বের করা হয়েছিল। কালক্রমে বর্তমানে এই উৎসবটি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। বর্তমানে পাহাড়ে বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে সকল জাতিসত্তাসমূহ নিজেদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সংস্কৃতি সকলের মাঝে তুলে ধরার পাশাপাশি এই উৎসবটি সকল জাতি-সম্প্রদায়, ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এবং সাধারণ জনগণ ঐক্য-সংহতি ও সু-ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনার একটি মেলবন্ধনও তৈরি করেছে।
তিনি আরো বলেন, বৈসাবি’র চেতনা যেহেতু সকল জাতিকে ঐক্যের মেলবন্ধন গড়ে তোলে, সে কারণে শাসকগোষ্ঠী চায় এই উৎসবের আমেজ যেন পাহাড়ের প্রত্যেকটি অঞ্চল ও প্রতিটি ঘরে ঘরে বয়ে না যাক। ফলে প্রতি বছর এপ্রিলে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের বৈসাবি উৎসব ঘনিয়ে আসলে সুপরিকল্পিতভাবে নানা ষড়যন্ত্র ও ঘটনা সংঘটিত করা হয়। ১৯৯২ সালে ১০ এপ্রিল লোগাঙ গণহত্যার ঘটনা তারই দৃষ্টান্ত।
এই বছরও বৈসাবি’র আগে-পরে পাহাড়ের সংঘটিত নানা ঘটনার তুলে ধরে তিনি বলেন, বৈসাবি উৎসবের আগে বান্দরবানের লামায় রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ-এর নামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল, বৈসাবি উৎসবের দিনে খাগড়াছড়ির পানছড়ি মাটিরাঙ্গা সীমান্ত তুলাতুলীতে বিজিবি সহযোগীতায় সেটলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়িদের চাষ করা শিমুল আলু, কচু চারা উপড়ে ফেলে দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা এবং বৈসাবি উৎসবের পর পরই খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে এক সেটলার ব্যবসায়ী নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়িদের দোকান ভাঙচুর, মারধর, মোটর সাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
তিনি সরকারের সমালোচনা করে বলেন, দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। বৈসাবি পাহাড়ি জনগণের প্রধান উৎসব হলেও তা পালনের জন্য সরকারি কোন ছুটি নেই। সে কারণে পাহাড় ও সমতলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা তাদের এই প্রাণের উৎসবটি নিজ এলাকায়, গ্রামে গিয়ে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, সমাজের সাথে মিলে মিশে আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। এ বছরেও পাহাড়ের অনেক শিক্ষার্থী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাস, পরীক্ষা থাকার কারণে উৎসব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সমতলে বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। অথচ আমরা দেখি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উৎসব হলে তাদের জন্য সাপ্তাহিক, মাসিক পর্যন্ত ছুটি থাকে।
তিনি পাহাড়ে বৈসাবি উৎসবে সরকারি ছুটিসহ সকল উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে এমন নিশ্চয়তা প্রদান ও পাহাড়িদের ওপর রাষ্ট্রের সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারে প্রতি আহ্বান জানান।
সভায় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দগণ বলেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে যার ফলে সেখানকার পাহাড়ি জনগণ অনিরাপদ। সেনাশাসনের যাঁতাকলে থাকা এই অঞ্চলে প্রতিনিয়ত জনগণের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আমরা যখন পাহাড়ে যাই তখন দেখতে পাই রাস্তায় রাস্তায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর ক্যাম্প চেকপোষ্ট বসানো আছে। এর মাধ্যমে বুঝা যায় সেখানে কি চলে। পাহাড়িদের বিভক্ত করে শাসন করার নীতি প্রয়োগ করে দেশের মানুষের কাছে সেখানে সংঘাত-হানাহানি দেখিয়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার চক্রান্ত জারি রাখা হয়েছে। কাজেই, এই পরিস্থিতি ও সমস্যাকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে আমরা যারা আন্দোলন বা লড়াই সংগ্রাম করছি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম সৃষ্টি করে সরকার ও শাসকগোষ্ঠী সর্বপোরি এই রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে দিয়ে একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হবে। শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন করার মাধ্যমে সকল জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শুভেচ্ছা বিনিময় সভায় পিসিপি’র সভাপতি সুনয়ন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় উপস্থিত থেকে আরো বক্তব্য রাখেন, পিসিপি সাবেক সভাপতি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থুইক্যচিং মারমা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সাদেকুল ইসলাম সোহেল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বারৈই, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি অনিক রায়, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সহ-সভাপতি দীপা মল্লিক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টে প্রচার সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রচার সম্পাদক সোহবত শোভন, পিসিপি কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অংকন চাকমা ও পিসিপির ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক অর্ণব চাকমা প্রমুখ।
এছাড়াও সভায় বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সাবেক সভাপতি ইকবাল কবির, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টে সাধারণ সম্পাদক শোভন রহমানসহ সকল সংগঠনের অন্যান্য নেতা-কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।
শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে নিজেদের হাতের রান্নার বৈসাবি’র ঐতিহ্যবাহী খাবার পাঁচন, পিঠা, মটরের বিরাণি ও নববর্ষ উপলক্ষে মিষ্টি, তরমুজ পরিবেশন করার মাধ্যমে আগত অতিথি ছাত্র নেতৃবৃন্দদের আপ্যায়ন করা হয়।