গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিনিধি।। আজ ৫ এপ্রিল ২০২২ পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুব সমাজের অগ্রগামী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২০০২ সালের আজকের এই দিনে চট্টগ্রাম নগরীতে সচেতন পাহাড়ি যুবকদের নিয়ে এই সংগঠনটি গঠিত হয়। গঠনকালে সংগঠনটির নাম ছিল “পাহাড়ি যুব ফোরাম”। এ সময় ৯ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। 

এরপর ২০০৩ সালের ৫ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনটির ১১ সদস্যের একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।

পরে ২০০৫ সালে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করা হয়। সে বছর ১৩ মে চট্টগ্রামের স্টুডিও থিয়েটার হল রুমে সম্মেলন আয়োজন করে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম” বা ইংরেজীতে “Democratic Youth Forum”।

গঠনের পর থেকে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ভূমি বেদখল, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ পাচার, অন্যায় দমন-পীড়ন ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি সংগঠনটি যুব সমাজের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও মাদক-জুয়ার সর্বনাশা কালো থাবা থেকে যুব সমাজকে রক্ষায় নানা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

২০০৬ সালের প্রথমদিকে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিভিন্ন সরকারি দলিলপত্রে “উপজাতি” শব্দটি ব্যবহারে বিতর্কিত সার্কুলার জারি করলে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের পক্ষ থেকে ঐ বছর ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ানের মাধ্যমে সরকারের কাছে লিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় সকল প্রচার মাধ্যম, সরকারি গ্যাজেট-দলিলসহ প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আইনগতভাবে “উপজাতি” শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তদস্থলে “জাতিসত্তা” (Nationality) শব্দটি চালু করার দাবি জানানো হয়।

খাগড়াছড়িতে আযোজিত ১ম যুব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ। ১৫ মার্চ ২০০৬। #ফাইল ছবি

একই বছর (২০০৬) ১৫ মার্চ খাগড়াছড়িতে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে বিশালাকারে ১ম যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভূমি বেদখল ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে স্বনির্ভর মাঠে আয়োজিত উক্ত ‍যুব সম্মেলনে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এদিন স্বনির্ভর মাঠ থেকে হাজার হাজার যুব-জনতা মিছিল নিয়ে পুলিশের কয়েকটি ব্যারিকেড ভেঙে খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মুখে গেলে পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে ২ জনকে আটক ও বেশ কয়েকজনকে আহত করে।

সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতেও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে, এখনও একই দাবিতে অনড় রয়েছে। ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে তড়িঘড়ি করে বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করলে ঐ বছর ১ জুলাই যুব ফোরাম চট্টগ্রাম নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানায়।

সেমুতাঙের গ্যাস পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পাচারের প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম বিক্ষোভ, ৪ ডিসেম্বর ২০১১ । # ফাইল ছবি

খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ির সেমুতাঙ গ্যাস ফিল্ড থেকে উত্তোলিত গ্যাস পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পাচারের বিরুদ্ধেও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম আন্দোলন করেছে। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর সংগঠনটি খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে সেমুতাঙের গ্যাস বাইরে পাচারের প্রতিবাদ জানায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীর একতরফা বিতর্কিত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের একতরফা শুনানী বাতিল ও পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতির দাবিতে সংগঠনটি ২০১২ সালের ২৩-২৪ মে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে লাগাতার ৩৬ ঘন্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ এবং বান্দরবানের একদিনের সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচি থেকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলামকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

ভূমি কমিশন ঘেরাও কর্মসূচির পোস্টার। #ফাইল ছবি

একই দাবিতে সংগঠনটির ডাকে ঐ বছর ১০ জুন খাগড়াছড়িতে ভূমি কমিশন অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হয় এবং পুলিশ উক্ত ঘেরাও কর্মসূচিতে হামলা চালালে পরদিন ১১ জুন খাগড়াছড়ি জেলায় ২১ ঘন্টা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়।

সংগঠনটির এসব প্রতিবাদী কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সরকার খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে সরাতে বাধ্য হয়।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ২০১৩ সালের ৩০ জুন ‘সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, রাঙামাটিতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষনার নামে অবৈধ ভূমি বেদখল প্রক্রিয়া বন্ধ ও রামগড়ে ম্রেলাপ্রু কার্বারী পাড়া থেকে ৫০ পাহাড়ি পরিবারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বন্ধের দাবিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে দিনব্যাপী সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।

এভাবে বিভিন্ন সময়ে সংগঠনটি ভূমি বেদখল ও নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ঙ্গত দাবিতে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করে এসেছে এবং করে যাচ্ছে। একক সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি পালন ছাড়াও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন’র সাথে যুক্তভাবে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের যুব ফোরাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আট গণসংগঠনের কনভেনিং কমিটিরও অন্যতম সংগঠন হচ্ছে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রীয় কঠোর দমন-পীড়ন মোকাবেলা করে সংগঠনটি সক্রিয়ভাবে তার কার্যক্রম অবিচলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি হিসেবে অংগ্য মারমা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জিকো ত্রিপুরা দায়িত্বে রয়েছেন।

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে সংগঠনটি ২০ বছর পূর্ণ করে ২১ বছরে পদার্পণ করছে। গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল ধরনের অন্যায়-অবিচার, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করবে এবং যুব সমাজকে সংগঠিত করে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার ন্যায্য অধিকার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এগিয়ে নেবে– এমনই প্রত্যাশা সবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *