ভূমিধ্বস: পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের যাপিত জীবনে এক আতঙ্ক

ভূমিধ্বস একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা ও অস্তিত্ত্বের জন্য এখনও হুমকী হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কিন্তু, এ দুর্যোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরোপুরি মানব সৃষ্ট। পাহাড় কাটা, গাছপালা ধ্বংস সাধন, মাটি খুড়া, বনজ সম্পদ উজাড়করন, অবৈধ পাথর উত্তোলন, অপরিকল্পিত স্থাপনা স্থাপন ইত্যাদি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধ্বসের মূল কারণ। রাঙামাটির নান্ন্যেচরে (নানিয়াচর) ১২ জুন ২০১৮ তারিখে ভারি বৃষ্টিপাতে কমপক্ষে ১০ জন মৃত্যুবরন করেন। ২১ মে ২০১৮ তারিখে বান্দরবনের নাক্ষ্যংছড়িতে ঘুমডুম এলাকায় একটি নালা খুড়তে গিয়ে ভূমিধ্বসে এক নারীসহ তিনজন শ্রমিক নিহত হন। রাঙ্গামাটিতে অনেক এলাকায় যেমন- রিজার্ভ বাজার, উন্নয়ন বোর্ড, পুরাতন বাস স্টেশন, শিমুলতলী, সাপছড়ি, মানিকছড়ি, ডেপ্পোছড়ি, ভেদভেদী ও ঘাগড়ায় এরকম ভূমিধ্বসের খবর জানা যায়। অত্যদিক বৃষ্টিপাতের কারণে রাঙ্গামাটির ৫টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়। অন্যদিকে, রাঙ্গামাটিতে এখনও ৩১টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৬০০ পরিবার বসবাস করছে। এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত ৩১টি পাহাড় রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে সতর্কতা জারি করেছে।

এছাড়াও ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনেক সেতু, ভাঙা রাস্তা ও ঘরবাড়ি জরুরী ভিত্তিতে মেরামতের প্রয়োজন রয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাতের সময় বৃষ্টির পানি সরানোর জন্য যদি নালার ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে ২০১৭ সালের ভয়াবহ ভূমিধ্বসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। এটা হতাশাজনক যে, ২০১৭ সালে এরকম একটা ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভূমিধ্বসের পরেও প্রশাসন পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, জনবল, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরনের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। ইতোমধ্যে, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙ্গামাটিতে কিছু কিছু সেতু ও রাস্তায় ফাটল ধরেছে ও ভেঙেছে বলে জানা যায় যা চলাচলের জন্য অনিরাপদ। ২০১৮ সালের জুন মাসে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ভূমিধ্বস নিরোধে একটি কমিটি গঠনসহ মোট ৩৫টি সুপারিশ আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটিকে জমা দেয়।

অভূতপূর্ব ধ্বংসাত্মক ভূমিধ্বসের কারণ চিহ্নিতকরণের জন্য আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব উক্ত কমিটির আহ্বায়ক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণারয়, ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে প্রতিনিধি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি এবং ৫ জেলার জেলাপ্রশাসকদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত হয়। ভূমিধ্বসের কারণ জানতে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। ইতোমধ্যে, উক্ত কমিটি আদিবাসীদের সাথে না বসে ও পরামর্শ না নিয়ে তাদের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশ করে। আশ্চর্যজনকভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ থেকে কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি যদিও চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রণয়নে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।

এটি স্মর্তব্য যে, ২০১৭ সালের ১৩ ই জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবনে কয়েকদিন যাবত ভয়ানক ও আকষ্মিক বজ্রপাতসহ অবিশ্রান্ত ও প্রবল বৃষ্টিপাতে ব্যাপকভাবে ভূমিধ্বস হয়। স্মরণকালের ইতিহাসে সংঘটিত এ অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক দুর্যোগে শুধু রাঙ্গামাটিতে ১২১ জনসহ বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মোট ১৭০ জন মৃত্যুবরণ করেন যেখানে ২২৭ জন মারাত্মকভাবে জখম হন। তাছাড়া এ ভূমিধ্বসে হাজার হাজার একর ফলের বাগান, কৃষিজমি, শস্যক্ষেত ও ঘরবাড়িসহ ব্যাপক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। অভিজ্ঞরা বলেছেন, সর্বনাশা এ দুর্যোগে রাঙ্গামাটি শহরে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক শুধু রাঙ্গামাটি জেলাতে রাঙ্গামাটি সদর, কাউখালী, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী ও নানিয়াচরে ১২৪৫০ পরিবারসহ মোট ১৫০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধারাবাহিক ভূমিধ্বস ও মৃত্যু সত্ত্বেও খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় ভূমিগ্রাসী ও প্রভাবশালী লোকেরা তাদের পাহাড় কাটার কাজ অব্যাহত রেখেছে। ভূমিগ্রাসীরা তাদের এ অপকর্ম স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে করে থাকে। প্রশাসন অপরাধীদের ধরতে নিষ্ক্রিয়তা দেখায়। হুমকীতে আছে এমন এলাকার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা পার্বত্য জেলাগুলোর যথাযথ কর্তৃপক্ষের এখনও তৈরি হয়নি বলে জানা যায়। এ কারণে হয়ত প্রশাসন ভূমিধ্বসে জীবনের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে অপ্রস্তুত ছিল। প্রতিবছর প্রত্যেক পার্বত্য জেলায় বর্ষা মৌসুম প্রারম্ভের আগে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো পরিচিহ্নিত করা হয়। ভুমিধ্বস বিগত এক দশক ধরে নিয়মিতভাবে সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, যত্রতত্র এলাপাতাড়ি মানব বসতি স্থাপন ও বন উজাড়করন সাম্প্রতিক দুর্যোগের প্রধানতম কারণ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ চিং এর আবাসন প্রকল্পের রাস্তা নির্মাণের জন্য দক্ষিণ পূর্ব জেলা বান্দরবনে বুলডোজার দিয়ে পাহাড় ধ্বংস করা হয়। ৩৬ একর পাহাড়ী ভূমির উপর এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়।
৫ একরের ৪ থেকে ৫টি পাহাড় ইতোমধ্যে দুটি রাস্তার জন্য কেটে সমান করা হয়েছে যেগুলো উক্ত আবাসিক এলাকায় ক্রিসক্রস হিসেবে থাকবে। এসমস্ত অবৈধ কার্যক্রম না থামিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও বান্দরবন পৌরসভা প্রত্যেকেই পাহাড় ধ্বংস করে রাস্তা তৈরিতে যুক্ত। ঐ ৩৬ একর জায়গায় একসময়ের মালিক বোমাং রাজ পরিবার ২০০২ সালে তা বিক্রি করে দেয়।

এটা সর্বজন বিদিত যে, অভূতপূর্ব এ ভূমিধ্বসের প্রধান প্রধান কারনগুলোর অন্যতম হচ্ছে বনজ সম্পদের ব্যাপক লুটপাত, সেগুন বাগান সৃষ্টি, পরিবেশবিরোধী বিদেশী জাতের গাছ লাগানো, বনবিভাগ কর্তৃক প্রাকৃতিক বন ধ্বংস এবং বহিরাগতদের ব্যাপকহারে পাহাড় লীজ দিয়ে বেপরোয়াভাবে রাবার বাগান সৃষ্টি। অন্যদিকে, হীন উদ্দেশ্য ও রাজনৈতিকভাবে পাহাড়ী এলাকা ও পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অদক্ষ ৪ লক্ষ বহিরাগত বাঙালিকে ১৯৮০’র দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি দিয়ে, এবং ব্যাপক জনসংখ্যার ধারাবাহিক চাপ ভয়াবহ এ ভূমিধ্বস ও ব্যাপক প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসসাধনকে ত্বরান্বিত করেছে। এটি পাহাড়ী ও বাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে যা হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে।

তৃতীয়ত, হাজার হাজার পাহাড়ী যারা সেটেলার কর্তৃক তাদের ভিটেমাটি বা ঘর থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন বা সাম্প্রদায়িক আক্রমনের কারনে উদ্বাস্তু হয়েছেন তারা রাঙ্গামাটি শহরের কোণায় কোণায় বা এর আশেপাশে ভিড় জমিয়েছেন। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হলেও যেখানে জায়গা পেয়েছেন সেখানে তারা বসতি নির্মাণ করেছেন। রাঙ্গামাটি ও অন্য পাহাড়ী শহরে ভূমিধ্বস হওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। চতুর্থত, কেউ কেউ সশস্ত্র সংঘাতের সময় গ্রামে অনিরাপদ বোধ করায় এ পাহাড়ী শহরে বাধ্য হয়ে বসতি গড়েছে এমন অভিবাসীও রয়েছে। বসতি নির্মানের জন্য সমান জায়গা না থাকায় তারা এমনকি পাহাড়ী ঢালু জায়গায় ঘর বানাতে বাধ্য হয়েছে। ছোট এ শহরে ব্যাপক মানুষের সন্নিবেশ ঘটেছে।

জমির জন্য টানাটানি অবস্থায় সামান্য একটা আশ্রয় তৈরির জন্য মানুষ সামান্যটুকু পাহাড়ী ঢালু জমি সামনে যা পেয়েছে তা নিয়ে নিয়েছে। অবস্থা এমন যে, পাহাড়ী ঢালু জমিতে বাড়ি নির্মাণ ছাড়া তাদের অন্য কোন বিকল্প নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ি তৈরিতে তাদেরকে ঢালু জমি কেটে সমানও করতে হয়েছে। এসব কারণেও পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। অনুরূপভাবে, সেটেলার বাঙালীরাও প্রশাসনের সহযোগীতায় পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করেছে। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাকে বিবেচনায় না নিয়ে যেখানে সেখানে এরকম বসতি নির্মাণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এসকল কারণসমূহের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৭ সালের মত ভূমিধ্বস ও অন্যান্য ভূমিধ্বসগুলো সংঘটিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *