‘উন্নয়ন’ যখন প্রাণবিনাশী পথ ধরে

আনু মুহাম্মদ

অলঙ্করন : প্রবা । ছবি সৌজন্যে: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

বর্তমান ধারার ‘উন্নয়ন’ ধাক্কায় বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতির অসাধারণ কোনো সম্পদই আর অবশিষ্ট থাকবে না। যেকোনোভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কতিপয় গোষ্ঠীর দ্রুত মুনাফা নিশ্চিত করা আর দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থাপনা নির্মাণই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই লক্ষ্য প্রতিষ্ঠায় দখল, অনিয়ম, জুলুম, প্রাণপ্রকৃতি বিনাশ সবকিছু করা যেন বৈধ। সুন্দরবন থেকে বাঁশখালী উপকূল অঞ্চল, দেশের ভেতরের নদী মাঠ বন জলাশয় সবই যথেচ্ছাচারের শিকার। অনেক ভালো বিকল্প আছে, কিন্তু উচ্চ মুনাফা আর দখলের টানে এসব সর্বনাশা প্রকল্পই রাষ্ট্রের জোর পাচ্ছে।

বর্তমানে যে উন্নয়ন ধারা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মহাদাপট নিয়ে কর্তৃত্ব করছে তার পোশাকি নাম ‘নয়া উদারতাবাদ’। পুঁজিবাদের কট্টর পর্ব এটি। ‘উদারতা’ শব্দ থাকায় তা বিভ্রান্তি তৈরি করে, কিন্তু আসলে এই ‘উদারতা’ মানুষের জন্য কোনো উদার ব্যবস্থা নির্দেশ করে না। প্রকৃতপক্ষে এটি পুঁজির জন্য উদার উন্মুক্ত বিশ্বব্যবস্থার তাত্ত্বিক যৌক্তিকতা উপস্থিত করে। ভেতর থেকে এটি চরম রক্ষণশীল। রক্ষণশীলতা এবং এর বৃত্তাবদ্ধ চিন্তার কাঠামোর কারণে অনেকে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘বাজার মৌলবাদ’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এই মতবাদের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিলটন ফ্রিডম্যান, রাজনীতিবিদদের মধ্যে রোনাল্ড রেগ্যান, মার্গারেট থেচার; প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউএসএইড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর সুবিধাভোগী বিশ্বের একচেটিয়া করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে দেশে দেশে দুর্নীতিবাজ দখলদার ব্যক্তি-গোষ্ঠী। এর শিকার পৃথিবীর প্রাণপ্রকৃতি পরিবেশ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এই ব্যবস্থায় পুঁজির সংবর্ধন প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ উপায়ে হয় না। কেননা পুরো প্রক্রিয়াটি অন্তর্গতভাবেই সহিংস।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬০ দশকে শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথাকথিত এক ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প। মানুষকে কিছু না জানিয়ে, মানুষ ও প্রকৃতির কথা না ভেবে, বিদেশি ঋণ নিয়ে কাজ শুরু হলো। এক রাতে এই প্রকল্পের ‘শুভ উদ্বোধনে’ গ্রাম-শহর ডুবে গেল, লাখ মানুষ ভেসে গেল। এভাবেই বৈরিতা আর সহিংসতার বীজ বপন ঘটল। এটা পাকিস্তান আমলের ঘটনা। বাংলাদেশ তা একটুও বদলায়নি, বরং তার ওপর ভর করেই এগিয়েছে। সরকার পরিবর্তনেও ধারার পরিবর্তন ঘটেনি। গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে সহিংসতা, সামরিকীকরণ, জবরদস্তি, নির্যাতন, দখল, জাতিগত অস্তিত্বের অস্বীকৃতি ও অবমাননা এসবই পার্বত্য চট্টগ্রামের দিনের পর দিনের কাহিনি। ‘উন্নয়নের’ ইতিহাস!

সংক্ষেপে বললে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে এই উন্নয়ন ধারা চিহ্নিত করা যায় : প্রথমত, সর্বজনের সম্পদ ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া। সর্বজনের সম্পদ বলতে বোঝায় নদীনালা খালবিল বন-পাহাড় উন্মুক্ত জমি, অর্থাৎ যার মালিক সবাই, যেখানে প্রবেশাধিকার সব মানুষের– এসবই ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয় উন্নয়নের ধুয়া তুলে।

দ্বিতীয়ত, সর্বজনের অধিকারের ক্ষেত্রগুলোকে ব্যক্তির মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করা। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষা ও চিকিৎসা। এসব বিষয় সর্বজনের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও, ক্রমেই এগুলো পরিণত হচ্ছে উচ্চ মুনাফা অর্জনে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। অধিকারের বদলে এগুলো পরিণত হচ্ছে ব্যয়বহুল মানহীন পণ্যে।

তৃতীয়ত, অর্থনীতিসহ দেশের সব নীতিনির্ধারণী বিষয় কতিপয় দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর কঠিন নিয়ন্ত্রণে রাখা।

চতুর্থত, সর্বজনের সম্পদের ওপর পুঁজির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজটি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সহিংস বিভাগগুলোকে শক্তিশালী করা। ব্যক্তিমালিকানাধীন সন্ত্রাসী বাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন, সন্ত্রাস, গোয়েন্দা সংস্থার দাপট এবং কর্তৃত্ববাদী তৎপরতা বৃদ্ধি।

পঞ্চমত, একই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, বৈষম্য ও চোরাই টাকার অনুপাত বৃদ্ধি। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্রমে দেশি-বিদেশি করপোরেট গোষ্ঠীর লাঠিয়ালে পরিণত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ‘উন্নয়ন’ যাত্রা এই মডেলেই পরিচালিত হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬০ দশকে শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথাকথিত এক ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প। মানুষকে কিছু না জানিয়ে, মানুষ ও প্রকৃতির কথা না ভেবে, বিদেশি ঋণ নিয়ে কাজ শুরু হলো। এক রাতে এই প্রকল্পের ‘শুভ উদ্বোধনে’ গ্রাম-শহর ডুবে গেল, লাখ মানুষ ভেসে গেল। এভাবেই বৈরিতা আর সহিংসতার বীজ বপন ঘটল। এটা পাকিস্তান আমলের ঘটনা। বাংলাদেশ তা একটুও বদলায়নি, বরং তার ওপর ভর করেই এগিয়েছে। সরকার পরিবর্তনেও ধারার পরিবর্তন ঘটেনি। গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে সহিংসতা, সামরিকীকরণ, জবরদস্তি, নির্যাতন, দখল, জাতিগত অস্তিত্বের অস্বীকৃতি ও অবমাননা এসবই পার্বত্য চট্টগ্রামের দিনের পর দিনের কাহিনি। ‘উন্নয়নের’ ইতিহাস!

যে সুন্দরবন আমাদের বিপুল সম্পদ জোগান দেয়, যে সুন্দরবন প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, জীববৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার হিসেবে যা আমাদের সবার প্রাণ সমৃদ্ধ করে, যে বন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের প্রধান অবলম্বন, যে বন জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান শক্তি, বর্তমানে সরকার তার বিনাশ করছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে। সুঁই থেকে রকেট সবই আমরা তৈরি করতে পারব কিন্তু এ রকম অসাধারণ জীববৈচিত্র্য ভরা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবন আরেকটি তৈরি করতে পারব না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সুন্দরবন আক্রমণকে ‘উন্নয়ন’ বলে চালিয়ে বন-জমি গ্রাসকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

একদিকে গ্যাসের সংকট বলে সরকার ঋণনির্ভর সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প, রূপপুর প্রকল্প, মানুষ খুনের ওপর বাঁশখালী প্রকল্প করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা নষ্ট করে কিছু দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারের তৎপরতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। একদিকে গ্যাসক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য জাতীয় সংস্থাকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে; অন্যদিকে আমদানি করা হচ্ছে এলএনজি। বাড়ছে গ্যাসের দাম।

বিপুল ঋণনির্ভর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকি নিয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই; অন্যদিকে এই প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে কোম্পানিকে পুরো দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতীয় কোম্পানিকে। তাদেরও দেওয়া হচ্ছে দায়মুক্তি। পুরো অস্বচ্ছতা, আর্থিক বোঝা এবং ভয়ংকর জাতীয় বিপদ তৈরি করতে করতে প্রকল্পের কাজ অগ্রসর হচ্ছে।

বর্তমান উন্নয়ন মডেলে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি বিদ্বেষ, নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিকট অতীতে গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জমি দখল করতে গিয়ে নির্বিচার গুলি, গরিব মানুষদের ঘরে ঘরে আগুন, নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী তৎপরতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিয়ে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন ইত্যাদির অন্যতম লক্ষ্য ভূমিগ্রাস। রামুতে মানুষ উচ্ছেদ করে, প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে ফেলে পাঁচতারা হোটেলের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ম্রো জনগোষ্ঠী উচ্ছেদ করে রাবার প্ল্যান্ট করার জন্য পানিতে বিষ মেশানো হচ্ছে, ঘরে আগুন দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারক বাহাদুর শাহ পার্ককেও দখলদারদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কারখানায় কারখানায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে গিয়ে একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে শ্রমিকরা। কেবল শ্রমিকরা নিজেদের মজুরি আর নিরাপত্তার কথা বললেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য সময় চুপ। প্রতিবছরের একাধিক ঘটনা এর সাক্ষী।

বাংলাদেশের প্রাণ এই দেশের নদী। অথচ বহু নদী মারা গেছে বা যাচ্ছে উন্নয়ন নামের বিভিন্ন প্রকল্পের কারণেই। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা তার আরেকটি ফলাফল। বহু মানুষ যে নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে শহরে উদ্বাস্তু, তারও বড় কারণ এইসব প্রকল্প। সরকার পরিবর্তনে এর ধারাবাহিকতার কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ এর সুবিধাভোগী অভিন্ন। এ দেশের নদী ও বনবিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প, সড়ক-সেতু-ভবন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি, মানুষের জীবন ও সম্পদ নিয়ে ভয়াবহ সব চুক্তি, ঋণনির্ভরতা সৃষ্টি, জাতীয় সক্ষমতার ক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নামের কনসালট্যান্ট এবং আমলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রকল্পে লাভবান হয় দেশ-বিদেশের কতিপয় গোষ্ঠী, তার মধ্যে বহু ‘বিশেষজ্ঞ’ও আছে, যারা এগুলোর কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না, কিন্তু ভোগান্তি বহন করতে হয় মানুষকে, প্রতিবাদ করলেও যাদের আঘাত পেতে হয়। উন্নয়ন নামের এসব প্রকল্পের যথেষ্ট বিরোধিতা হয়নি বলেই দেশে নদী পাহাড় জমি জলাশয় এবং শেষ বিচারে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

মেগা প্রকল্পে সরকারের আগ্রহ সবচাইতে বেশি। এসব প্রকল্পে নজরদারি বা জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই বলে তার ব্যয়বৃদ্ধির কোনো সীমাও নেই। জরুরি কাজে অর্থের অভাব হলেও এসব প্রকল্পে বছরে বছরে ব্যয় বাড়ছে। বাংলাদেশে সড়ক, সেতুসহ নানা নির্মাণকাজে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় এই কারণেই। লাখো কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দুর্নীতি আর চোরাই তৎপরতার মধ্যে। দুর্নীতি আর অপচয় বাড়লে জিডিপির আকারও বাড়ে। উন্নয়নের পরিসংখ্যান ভালো দেখা যায়। সরাসরি সহিংসতা, জবরদখল, আইন, প্রতিষ্ঠান ভঙ্গের মধ্য দিয়ে, সর্বজনের বিপন্নতা তৈরি করে কতিপয় গোষ্ঠীর মূলধন সংবর্ধনের মডেলে কাজ করছে বাংলাদেশ, যা উপস্থাপিত হচ্ছে ‘উন্নয়ন’ নামে।

‘উন্নয়ন’ শব্দটি সবার জন্য তাই একই অর্থ বহন করে না। উন্নয়ন কি সবার জীবনকে সমৃদ্ধ করবে, নাকি বহুজনের জীবন ও প্রকৃতির বিনিময়ে কতিপয়কে দানব বানাবে তা নির্ভর করে উন্নয়নের ধরন কেমন আর তার গতিপথ কারা নির্ধারণ করছে তার ওপর। পুঁজির স্বৈরশাসনের মধ্যে যখন আমরা বাস করি, তখন যে কোনো উপায়ে পুঁজির সংবর্ধনকেই ‘উন্নয়ন’ নাম দিয়ে আমাদের সামনে হাজির করা হয়। তার পরিণতি যাই হোক না কেন, প্রচারণার আচ্ছন্নতার কারণে উন্নয়নের সঙ্গে ধ্বংস বা বিপন্নতার পার্থক্য ধরতে সমাজ ব্যর্থ হয়।

লেখক : অর্থনীতি ও শিক্ষাবিদ

সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *