বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ায় ম্রো গ্রামবাসীদের লকডাউন (পাড়াবন্ধ) ভেঙে গ্রামপ্রধান লংকম ম্রোসহ দুই জনকে আটক করেছে পুলিশ।
আজ শুক্রবার (৩ এপ্রিল) ভোরে এ আটকের ঘটনা ঘটে।প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে এ তথ্য জানা গেছে।ভূমিদস্যু মেরিডিয়ান এগ্রো লিমিটেড কোম্পানির করা হয়রানিমূলক মামলায় তাদেরকে আটক করা হয়।বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী চলমান করোনা ভাইরাসের মহামারি সংক্রমন প্রতিরোধে ম্রোরা ঐতিহ্যগত নিয়মে গত ২৪ মার্চ থেকে নিজস্ব উদ্যোগে তাদের গ্রামে প্রবেশ রাস্তা বেড়া দিয়ে লকডাউন করে। কিন্তু পুলিশ তাদের এই সুরক্ষা ভেঙে দেয়।নীচে বুদ্ধজ্যোতি চাকমার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু দেওয়া হলো :গাছ কাটা ও চুরি মামলায় পাড়াবন্ধের বেড়া ভেঙে আসামি গ্রেপ্তার : লামা সরইলামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ার সশস্ত্র ম্রোরা মেরিডিয়ান কোম্পানির জমিতে অনধিকার প্রবেশ করেছে। রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমি থেকে আকাশমনি গাছ কেটেছে ২৫০টি, চুরি করেছে ১৫০টি। চুরি হওয়া ১৫০টি গাছের মূল্য সাত লাখ টাকা। নষ্ট ১০০টি গাছ পাঁচ লাখ টাকা। ঘটনা ২০ মার্চ। কার্বারীসহ (পাড়াপ্রধান) আটজন পাড়াবাসীর বিরুদ্ধে ২৯ মার্চ-২০২০ ইং লামা থানায় মামলা । সুতরাং ভয়ঙ্কর এ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে হবে পাড়ার লকডাউন ভেঙে!! তাই পুলিশ আজ শুক্রবার ভোরে ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ার পাড়াবন্ধের বেড়া ভেঙে পাড়ায় ঢোকে। কার্বারীসহ দুইজনকে ধরে নিয়ে যায়। ম্রোরা বলেছেন করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা ঐতিহ্যগত নিয়মে দুর্যোগকালিন পাড়াবন্ধ বা পুয়াভং করেছেন। সেটি পুলিশ ভেঙে দিয়েছে।
কী সেলুকাস! এ দেশের আইন ও পুলিশ এত দ্রুত চলে! কী আশ্চর্য সুন্দর!সরকারি নির্দেশ আছে করোনাভাইরাসে লকডাউন চলাকালে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী, জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ভয়াবহ আসামি না হলে সাধারণ মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ার নিরীহ ম্রোদের বিরুদ্ধে মেরিডিয়ান এগ্রো লিমিটেড কোম্পানির অভিযোগ আজকের নয়। কোম্পানি কয়েক বছর ধরে পাড়াটি উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। একবারতো এক সপ্তাহের মধ্যে পাড়া ছেড়ে চলে না গেলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার আলটিমেটামও দিয়েছিল। গত বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে এসে পাড়াবাসীর সমস্ত জমি দখলের চেষ্টা করেছে। এ সময় ম্রোরা জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।ম্রোদের অভিযোগ- সরকারি দপ্তরের অসাধু কেউ কেউ কোম্পানির ভাড়াতে হয়ে কাজ করে। কারন টাকা যার কাছে আইন তার হাতে। এজন্য এখন ম্রোদের আতঙ্কের আরেক নাম আইন। এ আইন দিয়ে তাদের ফাসানো হয় ও হচ্ছে।কোম্পানির দাবি ১৯৯৪ সালে রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া তিন হাজার একরের অধিক জমির কাগজ তাদের রেয়েছে। ম্রোরা বলেছেন যেখানে তারা বসবাস করছেন সেটি বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের জুমের জমি। কাগজ দেখালে কী জমি কারো হয়ে যায়? রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমিতে রাবার ছাড়া অন্য কিছু করা যাবে না ইজারাশর্তে বলা আছে। তাও ইজারার ১০ বছরের মধ্যে রাবার বাগান করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইজারা বাতিল হবে। তাহলে রাবার বাগানের ইজারা প্লটে আকাশমনি গাছ কাটলো কোথা থেকে? কাটলেতো রাবার গাছ কাটার কথা।ম্রোরা বলেছেন তাঁরা জুম কাটছিলেন তাঁদের জুমের জমিতে। বাড়ি মেরামতের জন্য বন থেকে ১০-১২টি গাছ কেটেছেন। সেটি কোম্পানি দাবি করছে বাগানের গাছ। সেগুলো বনের গাছ।পাড়ার ইনচ্যং ম্রো জানিয়েছেন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লামায় ২৪ মার্চ রাত ৮ টা থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। কক্সবাজারে একজন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কারণে। কিন্তু ২৫ মার্চ ভোরে কোম্পানি নামধারী ভূমিদখলদাররা পাড়ায় পুলিশ নিয়ে আসে। পুলিশ কয়েকজন পাড়াবাসীকে ধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। করোনা ভয়াবহতায় ২৭ মার্চ থেকে ম্রোরা পাড়া লকডাউন করেছে। পাড়াবন্ধের সময়ে কোম্পানির লোকজন হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল। আজ শুক্রবার সেই ধারাবাহিকতায় পুলিশ এসে লকডাউন ভেঙে পাড়ায় ঢোকে। পাড়ার কার্বারী লংকম ম্রোসহ দুইজনকে ধরে নিয়ে গেছে।ঠিক যেন উনবিংশ শতাব্দির শেষার্ধে বিরসা মুণ্ডাদের মতো অবস্থা। দিকুরা পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে কাগজ বা দলিল তৈরি করে মুণ্ডাদের মুণ্ডারিজগতকে কেড়ে নিয়েছে। বাধা দিলে কিংবা অধিকাররের কথা বললে আইন অমান্যকারি, সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রদ্রেহি। ম্রোদেরও সেই একই অবস্থা করেছে ও করছে কোম্পানি নামধারী ভূমিদস্যু দিকুরা। প্রশাসনের তৈরি করা দলিলে ম্রোরা বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী ধরে বসবাসের জায়গা-জমিতে দখলদারে পরিণত হয়েছে। আর দিকু দস্যুরা হয়েছে ভূমির মালিক! বেঁচে থাকার অধিকারে কথা বললে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। কী সেলুকাস! এ দেশে কি এখনও উপনিবেশিকরা রয়ে গেছে!!