মাইসছড়ি জয়সেন পাড়ায় সেনাক্যাম্প স্থাপন পাহাড়িদের ভূমি বেদখলের নতুন ষড়যন্ত্র!

জয়সেন পাড়ায় নতুন স্থাপিত সেনা ক্যাম্প (গোল চিহ্নিত)। ছবিটি একটু দূর থেকে তোলা।

নিজস্ব প্রতিবেদক।। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার ২৫০ নং লেমুছড়ি মৌজার মাইসছড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের জয়সেন পাড়ায় গত ৫ জুলাই ২০২২ সেটলার বাঙালিরা ভূমি বেদখলের উদ্দেশ্যে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এতে পাহাড়িদের ৩৮টি ঘরের মধ্যে ২৭টি ঘর আগুন লাগিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই করে দেওয়া হয়। এছাড়া বাকী ঘরগুলোও বেশ ক্ষতির শিকার হয়। হামলাকারী সেটলাররা ঘরের সকল জিনিসপত্রও লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলের পাশে অবস্থান করলেও তারা হামলাকারী সেটলারদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে তারা নির্বিঘ্নে ঘরবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করার সুযোগ পায়। আর হামলার পর ঘরবাড়ি হারা পাহাড়িরা প্রাণের ভয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন।

জয়সেন পাড়ায় সেটলার কর্তৃক পুড়ে দেওয়া পাহাড়ি ঘর। ফাইল ছবি

হামলার পরবর্তীতে নিরাপত্তার নামে গত ২১ জুলাই ২০২২ উক্ত স্থানে একটি সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিজিতলা সাবজোনের দায়িত্বরত মেজর মো. তাহসিনের নির্দেশে উক্ত ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে।

এদিকে, নতুন স্থাপিত ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা নানা অজুহাত দেখিয়ে পাহাড়িদেরকে নিজেদের ভূমিতে চাষাবাদ ও বসবাস করতে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে স্পষ্টত বলা যায় যে, নিরাপত্তার কথা হলেও কার্যত পাহাড়িদের ভূমি জবরদখলের ষড়যন্ত্র ও সেটলার বাঙালিদের সহায়তা প্রদান করতেই সেনাক্যাম্পটি সেখানে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর যদি সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তা দেয়ার মানসিকতা থাকতো তাহলে ৫ জুলাই পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে সেটলাররা অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট চালাতে পারতো না। সেদিন তারা নিশ্চয় পাহাড়িদের ঘরবাড়ি রক্ষায় এগিয়ে আসতো। কিন্তু তারা তা করেনি, বরং সেটলারদের সহায়তা প্রদান করেছে।

এখানে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৫ জুলাই সেটলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর স্থানীয় মহালছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কিন্তু তারা সুষ্ঠু কোন সমাধান দিতে পারেননি, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেননি। উপরন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ‘পাহাড়িরা নিজেরাই তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে’ এমন মিথ্যা, বানোয়াট কথাবার্তা বলে সেটলার বাঙালিদের পক্ষাবলম্বন করতেও দ্বিধা করেননি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ও সুষ্ঠু বিচার চেয়ে ৭ জুলাই স্থানীয় হেডম্যান, কার্বারী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। এতে তারা জয়সেনপাড়া গুচ্ছগ্রামের জহিরুল হক, আব্দুল আজিজ, বেলাল উদ্দিন, সাইফুল ও জাহিদুল ইসলাম গংদের নেতৃত্বে ৫ জুলাই পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে অভিযোগ করেন। স্মারকলিপিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের ক্ষতিপূরণসহ ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া, ঘটনায় জড়িত সেটলারদের আইনের আওতায় আনাসহ ছয়টি দাবি জানান।

অপরদিকে, প্রশাসনের সহায়তায় হামলাকারী সেটলাররা উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত ৫ জন পাহাড়ির বিরুদ্ধে মহালছড়ি থানায় ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে। বর্তমানে ওই মামলাটি চলমান রয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা জানিয়েছেন, উক্ত জায়গায় সেনাক্যাম্প স্থাপন করার কারণে তারা আর নিজেদের বসতভিটায় যেতে পারছেন না। সেনাবাহিনী তাদের সেখানে যেতে বাধা প্রদান করছে। ফলে তারা এখন অন্যত্র বসবাস করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। উক্ত জায়গায় তারা যে জুমচাষ ও ফলজ বাগান-বাগিচা করেছিলেন সেনাবাহিনীর বাধার কারণে সেগুলোও আর পরিচর্যা করতে পারছেন না। এর ফলে তারা প্রভুত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে তারা জানান।

পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারাও সেনাবাহিনী সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা হয়রানির অভিযোগ করেছেন। তারা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সেনা সদস্যরা নিরাপত্তার নামে টহলে বের হলে কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই উৎপাদিত কলাগাছ থেকে কলাছরা কেটে নিয়ে যায়। এছাড়া নানা হুমকি-ধামকি ও হয়রানি করে থাকে বলে তারা অভিযোগ করেন।

পাহাড়িদেরকে নিজ বসতভিটায় যেতে না দেয়ার কারণ হিসেবে সেনাবাহিনীর অজুহাত হচ্ছে, যেহেতু উক্ত জায়গা নিয়ে মামলা হয়েছে, সেহেতু আদালতে মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে যারা প্রকৃত মালিক নিশ্চিত হবেন তারাই সেখানে বসবাস করতে পারবেন।

কিন্তু জনমনে প্রশ্ন হলো, যারা হামলা করেছে, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট চালিয়েছে সেই সেটলার বাঙালিদের বিরুদ্ধে কেন কোন পদক্ষেপ বা কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? উল্টো তাদেরকে কেন ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *