প্রত্যক্ষদর্শীদের লোমহর্ষক বর্ণনা: সেনারা নবায়ন চাকমা মিলনকে অমানুষিক নির্যাতনের পর অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে গেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক।। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইউপিডিএফ সংগঠক নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ)-কে গভীর রাতে ঘর থেকে বের করে তার উপর অমানুষিকভাবে শারীরিক নিয়াতন চালায়। এর ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। নির্যাতনের কারণে তার হাত পা ভেঙে যায়। সেনারা এমনকি তার গৌপনাঙ্গেও আঘাত করে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে এ তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ ২০২২ ভোররাত সাড়ে ৩টার সময় দীঘিনালা জোনের একদল সেনা সদস্য দীঘিনালা উপজেলার ৪নং দীঘিনালা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মনিভদ্র পাড়ার বাসিন্দা শান্তি রঞ্জন চাকমার বাড়ি থেকে ইউপিডিএফ নেতা নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ)-কে গ্রেফতার করে। তিনি সেনা মদদপুষ্ঠ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে দীর্ঘদিন ধরে সেখানে অবস্থান করছিলেন।

ঐদিন সেনারা বাড়ির মালিক শান্তিরঞ্জন চাকমাকেও হাত-পা বেঁধে নিপীড়ন ও হয়রানি করে, বাড়িতে তল্লাশি, জিনিসপত্র তছনছ এবং নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়।

উক্ত নির্যাতনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলেন শান্তি রঞ্জন চাকমার স্ত্রী এল্টি চাকমা (৪২) ও তার বাড়িতে থাকা ৮ম শ্রেণীর ছাত্র পনক দেওয়ান। সিএইচটি নিউজের প্রতিনিধির কাছে দেয়া সাক্ষাতকারে তারা সেদিন নবায়ন চাকমার ওপর লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

তারা জানান সেনারা নবায়ন চাকমা মিলনকে গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে অজ্ঞান ও অর্ধমৃত অবস্থায় সেখান থেকে নিয়ে যায়।

এল্টি চাকমা সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “সেদিন আর্মিরা আসা মাত্রই সবাইকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে। প্রথমে আমার স্বামী শান্তি রঞ্জন চাকমা বের হলে সাথে সাথে সেনারা তার হাত-পা বেঁধে ফেলে এবং মাটিয়ে ফেলে পা দিয়ে চেপে ধরে রাখে। আমি বের হয়ে দেখি সেনারা আমার স্বামীকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরে রেখেছে আর মিলনকে হাতে-পায়ে বেঁধে মারধর করছে। মিলনকে তারা হাতে-পায়ে বেঁধে মাটিতে ফেলে সাংঘাতিকভাবে মারধর করে। তারা লাঠি, বন্দুক দিয়ে মারধর করে, বুটজুতা পায়ে বলের মতো লাথি মারে, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়”।

তিনি বলেন সেনাদের অতিরিক্ত মারধরে তার হাত পা ভেঙ্গে যায়। পরে সেনারা তাকে অর্ধমৃত, অর্ধ জীবিত অবস্থায় নিয়ে যায়। তখন তিনি (সৌরভ, মিলন) সম্পূর্ণ অজ্ঞান ছিলেন।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ৮ম শ্রেণীর ছাত্র পনক দেওয়ান ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে “তার (মিলনের) কাছ থেকে সেনারা তার কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড জানতে চায়। তিনি তা দিতে না চাইলে সেনারা তাকে পাছায় ও অন্ধকোষে লাথি দিয়ে আঘাত করে। এরপরও তার কাছ থেকে পাসওয়ার্ড উদ্ধার করতে না পারলে সেনারা একটি ‘আঝার বিজি’ গাছের লাঠি দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বেদম মারধর করে। এক পর্যায়ে তাকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরে রাখে। এ অবস্থায়ও সেনারা আবার তাকে লাথি মারতে থাকে। একজন মারধর করে চলে এলে আবার অন্যরা গিয়ে তাকে মারধর করে। পরে তিনি অজ্ঞান হয়ে আর উঠতে না পারলে সেনারা তাকে পানি ঢেলে দেয়”।

পরে সেনারা সেখান থেকে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় কাঁধে করে নিয়ে যেতে দেখেছে বলে পনক জানায়।

এল্টি চাকমা সেনারা তাদের বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি ও জিনিসপত্র তছনছ করে দেয়ার অভিযোগও করেন। তিনি বলেন, সেনারা বাড়ির সব কাপড় চোপড় বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। তাদের তল্লাশি থেকে বাড়ির কোন জিনিস বাদ যায়নি। বস্তায় রাখা ধান, আমলকিসহ সকল জিনিসপত্র তছনছ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি বাড়িতে বসানো পুরোনো একটি মাটির চুলা ভেঙে দিয়ে সেখানে মাটি খুঁড়ে ফেলা হয় এবং বিছানার খাট উল্টিয়ে খাটের নীচে মাটি খুঁড়ে তল্লাশি চালায় সেনারা।

শুধু তাই নয়, সেনারা নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কর লুট করে নিয়ে গেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সেনারা প্রথমে বাড়ির এক জায়গা থেকে ৩৩,৪৭০টাকা, তার ব্যক্তিগত পার্স থেকে ৫,০০০ টাকা এবং তার দুই মেয়ের একজনের পার্সে ৩০০ ও আরেকজনের পার্সে ৭০টাকা ছিল, সেগুলোও সেনা সদস্যরা নিয়ে গেছে। টাকা খুঁজতে তাদের ব্যবহৃত সব বালিস ছিঁড়ে ফেলে দেয় বলেও তিনি জানান।

সেনারা তার কানের দুল ১ জোড়া ও ওই দুলের সাথে ছোট একটি ব্যাগে রাখা ৫০০ টাকাও নিয়ে গেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

উক্ত প্রত্যক্ষদর্শীদের ঘটনার বর্ণনা দেয়া সাক্ষাতকারের ভিডিওটি এই প্রতিবেদনের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আশা করি পাঠকরা সেদিন নবায়ন চাকমা মিলনের ওপর কী ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তা নিশ্চয় ধারণা করতে পারবেন।

উল্লেখ্য, সেদিন সেনারা নবায়ন চাকমাকে নির্যাতনের পর সেখান থেকে (আটকস্থল) এনে দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকালেই তার মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দেয়া মৃত্যু সার্টিফিকেটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সানজিদা সিএইচটি টুডে ডটকম নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে হাসপাতালে আনার আগে মিলনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন।

এদিকে তার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ঐ দিন দীঘিনালা ও বাঘাইছড়িতে তাৎক্ষণিকভাবে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে ইউপিডিএফ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। একই সাথে বিভিন্ন এলাকায় একযোগে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন সংগঠন উক্ত হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিচার দাবি করেছেন। উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে ইউপিডিএফ’র খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিট আগামী ২১ মার্চ খাগড়াছড়ি জেলায় আধাবেলা সড়ক অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *