সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫: উন্নততর, তবে দ্বৈততা তৈরি করবে কিছু ধারা

বহুল বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করেছে। আগের আইনের নয়টি ধারা বাদ পড়েছে, যেগুলোকে সরকার ‘কুখ্যাত’ বলেও অভিহিত করেছে। তবে বাদ পড়া ধারার কিছু বিধান নতুন অধ্যাদেশে রয়েছে। অধিকারকর্মীরা এই অধ্যাদেশকে আগের তুলনায় ভালো বললেও কিছু জায়গায় দ্বৈততা এবং ক্ষমতার স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।আইন মন্ত্রণালয় গত বুধবার সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫–এর গেজেট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সাইবার নিরাপত্তা আইনে নাগরিক সুরক্ষা–সংক্রান্ত বিধান অপ্রতুল থাকায় অপপ্রয়োগ ও নিপীড়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব করেছিল। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন বিতর্কিত ধারা এবং তার অপব্যবহারের কারণে আইনটি বাতিলের দাবি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গত ১ ডিসেম্বর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ওয়েবসাইটে নতুন অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করে মতামত চাওয়া হয়েছিল।অন্তর্বর্তী সরকার প্রকাশিত প্রথম খসড়াতেও কিছু ধারা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। সে অবস্থায় গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ তা অনুমোদন দেয়। সমালোচনার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার সেখানে আবারও কিছু সংশোধনী আনে।সর্বশেষ ৬ মে উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশের অনুমোদন দেয়। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করতে বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ করে ২৫ বার খসড়া পরিবর্তন করা হয়েছে।

যেসব ধারা বাতিল

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪ বাদ পড়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, উল্লিখিত ধারাগুলোয় নিষ্পন্নাধীন কোনো মামলা বা অন্যান্য কার্যধারা ও তদন্ত বাতিল হবে এবং কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়া এসব ধারায় আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ড ও জরিমানা বাতিল হবে।৬ মে সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এসব ধারাকে কুখ্যাত উল্লেখ করে বলেছিলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯৫ শতাংশ মামলাই এসব ধারায় হয়েছিল।

বাদ পড়া ধারাগুলোয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড; পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ; ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত; আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ; অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ইত্যাদির দণ্ড; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদি।

আরও ভালোর সুযোগ রয়েছে

অধ্যাদেশটি প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগের তুলনায় উন্নততর হয়েছে। অপব্যাখ্যার সুযোগ কমে এসেছে ও অনেক নেতিবাচক বিষয় সরানো হয়েছে। তবে দুটি দিকে তাঁর পর্যবেক্ষণ রয়েছে। প্রথমত, জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি পুরোপুরি সরকারি কর্তৃত্বে পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে; কিন্তু সরকার নিজেও একজন সাইবার সিস্টেম ব্যবহারকারী অংশীদার। ফলে এজেন্সির ভূমিকা স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত রাখা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হবে। মহাপরিচালক জবাবদিহির ঊর্ধ্বে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ পাবেন, যে অভিজ্ঞতার কারণে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) বিলুপ্তির যৌক্তিক দাবি উঠেছে। এজেন্সির মহাপরিচালকের কর্তৃত্ব সরকারি নির্দেশনা ও ছত্রচ্ছায়ায় থাকার ফলে সরকারের পছন্দ অনুযায়ী যথেচ্ছভাবে আইনটি প্রয়োগ হতে পারে।দ্বিতীয়ত, ২৫ জনের হেভিওয়েট জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলে ‘তথ‍্যপ্রযুক্তি বা মানবাধিকারবিষয়ক’ মাত্র দুজন বেসরকারি বিশেষজ্ঞের কথা আছে, তা–ও সরকার মনোনীত। যা বাস্তবে মানবাধিকার কর্মীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে না। এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়া উচিত।

অধ্যাদেশে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত সাইবার সুরক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে তা ব্লক করার জন্য এজেন্সির মহাপরিচালক বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এতে আরও বলা হয়েছে, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্বাস করে যে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করে, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ঘৃণামূলক বা জাতিগত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, যা সহিংসতা তৈরির উদ্বেগ সৃষ্টি করে বা বিশৃঙ্খলা বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা প্রদান করে, তাহলে তা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।

এই ধারা আগের আইনেও ছিল। যা সংশোধনের দাবি ছিল বিভিন্ন মহলের। অধ্যাদেশে এই বিধানে নতুন দুটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এক. স্বচ্ছতার স্বার্থে সরকার সব ব্লক হওয়া কনটেন্টের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। দুই. ব্লক করার তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অনুমতি গ্রহণ না করলে বা ট্রাইব্যুনাল অনুমতি না দিলে ব্লক করা কনটেন্ট অবমুক্ত করতে হবে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই অধ্যাদেশে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে বিচারিক তদারকির বিষয়টি এসেছে। তবে এর অর্থবহ ও দায়িত্বশীল প্রয়োগের জন্য একটি স্বচ্ছ ও স্বাধীন কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। বিশেষ করে, যদি কোনো ব্যক্তি কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হন, তবে তার জন্য অবশ্যই আপিলের সুযোগ থাকতে হবে, তা বিধির মাধ্যমে হোক বা বিচারিক পদ্ধতির মাধ্যমে।

সাইবার স্পেসে জুয়াসংক্রান্ত বিধান যুক্ত করাকে সাধুবাদ জানিয়ে এরশাদুল করিম বলেন, জুয়ার কোনো পোর্টাল বা অ্যাপ উৎপাদন করলেও শাস্তির বিধান রয়েছে। জুয়া বাংলাদেশে নিষিদ্ধ; কিন্তু যেসব দেশে জুয়া বৈধ, তাদের জন্য দেশের ফ্রিল্যান্সার জুয়াসংক্রান্ত কোনো অ্যাপ বা সাইট বানালে, তাদের জন্য কি এই বিধান কার্যকর হবে?

দ্বৈততা তৈরি করবে

সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে ধারাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ দায়েরসংক্রান্ত ৩৪ ধারাও রয়েছে; কিন্তু একই বিধান সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে ২৮ ধারায় রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী, যারা মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ দায়েরের মতো অপরাধ করেছে, আইনে আশ্রয় লাভের অধিকার চর্চা করেছেন এবং বাতিল করা সাইবার নিরাপত্তা আইনে মিথ্যা মামলার দায়েরকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত অধিকার চর্চা করেছেন, এই অধ্যাদেশে তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যা আইনের দ্বৈততা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে আগের ভুক্তভোগীরা অধ্যাদেশের মাধ্যমে মামলা থেকে মুক্ত এবং স্বাধীন জীবন পাবেন; কিন্তু নতুনরা দণ্ড পাবেন।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত–সংক্রান্ত ২৮ ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। যেখানে এ–সংক্রান্ত মামলা, তদন্ত ও সাজা সবই বাতিল হবে; কিন্তু একই বিধান অধ্যাদেশের ২৬ ধারায় রাখা হয়েছে। তাহলে একই ধারায় আগের যাঁরা মামলায় পড়েছেন, তাঁরা ভুক্তভোগী হিসেবে প্রতিকার পাচ্ছেন। আবার নতুন আইনে অন্যরা শাস্তি পাবেন। এ বিষয়টাও প্রশ্ন তৈরি করে বলে জানান রেজাউর রহমান লেনিন। তিনি আরও বলেন, অধ্যাদেশে অনুযায়ী, শিশুরা যদি অধ্যাদেশে বর্ণিত অপরাধ করে বা ভুক্তভোগী হয়, তাহলে তাদের জন্য কী ব্যবস্থা তার উল্লেখ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *