প্রতিবেদনে: সুমন বড়ুয়া
মাদকের ভয়াল ছোবলে দিশেহারা রাঙ্গুনিয়ার যুবসমাজ। হাত বাড়ালে পাওয়া যাচ্ছে পছন্দসই মাদক। পাড়া-মহল্লায় মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে চলছে মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়। চন্দ্রঘোনার ফেরিঘাট, ব্রিকফিল্ড কলোনি এখন জমজমাট ইয়াবা, বাবা নামের মাদক বিকিকিনির জমজমাট স্পট। সরফভাটা ইউনিয়নের উপজাতি পল্লী বড়খোলাপাড়া চোলাই মদ (বাংলামদ ) বিকিকিনির নিরাপদ রুট। উপজেলার পোমরার মালিরহাট হয়ে শান্তিরহাট, বুড়ির দোকান থেকে সিএনজি অটোরিক্সা দিয়ে সুকৌশলে চট্টগ্রাম শহরে পাচার হচ্ছে শতশত লিটার বাংলামদ । এছাড়া বেতাগীর কর্ণফুলী নদীর তীরে টংঘর, সিকদারপাড়া, বড়ুয়াপাড়া, বেপারীপাড়ার নদীর ওপার বোয়ালখালী থেকে বাংলামদ আসছে প্রতিদিন শতশত লিটার। এই বাংলামদের উৎপত্তিস্থল জঙ্গলসরফভাটার বড়খোলাপাড়া। পুলিশ এ পর্যন্ত চিহ্নিত কোন শীর্ষ ইয়াবা ও মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করতে পারেনি। দুয়েকজন কদাচিৎ ধরা পড়লেও দ্রুত জামিনে এসে আবারও দ্বিগুণ উৎসাহে মাদক কারবার শুরু করে। দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলেই রাঙ্গুনিয়ার শীর্ষ মাদক কারবারিরা গা ঢাকা দেয়। এদের মধ্যে রানীরহাটের আজিজুল হক প্রকাশ জলিক্কা, চন্দ্রঘোনার আমির হামজা প্রকাশ হামজু, রোয়াজারহাটের কালু, রানীরহাটের জলিক্কার পুত্র ইকবাল হোসেনসহ একডজন শীর্ষ মাদক কারবারি গা ঢাকা দেয়। পুলিশ মাদক আস্তানায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। তারা আত্মগোপনে চলে গেলেও একদিনের জন্যও মাদক বিক্রি বন্ধ হয়নি। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় অর্ধশতাধিক স্পটে কৌশল ও বিভিন্ন পন্থায় মাদক বিকিকিনি করছে। সূত্র জানায়, পুলিশ অভিযানে যাওয়ার আগে কথিত সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে কারবারিরা সতর্ক হয়ে যায়। যার ফলে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কাক্সিক্ষত সুফল পায় না। অপরাধীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে কথিত সোর্স নামধারীরা পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে অবৈধ টাকা উত্তোলন করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চন্দ্রঘোনার এক স্কুল শিক্ষক বলেন, অপসংস্কৃতি ও মাদকের ছোবলে ধ্বংসের পথে এখানকার যুবসমাজ। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে, পরিবার ও সমাজের জন্য ভয়ঙ্কররূপ ধারণ করছে তারা। আর এর পেছনে কারণ হিসেবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করছেন। রাজানগর ইউনিয়নের কৃষক মোহাম্মদ মুছা বলেন, স্কুল বা কলেজ থেকেই নেশার দিকে হাত বাড়ায়। ধীরে ধীরে বন্ধুদের আড্ডায় শুরু করে গাঁজা সেবন। সিগারেট ও গাঁজার পাশাপাশি নেশার উপকরণে যুক্ত হয় ফেনসিডিল। বছর দুয়েক হলো মরণ নেশা ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত। এভাবে একজন শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, সর্বত্র মাদকের ছড়াছড়ি। ঘরের বাইরে বেরিয়ে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে চোলাইমদ, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা। প্রতিদিনই ধরা পড়ছে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী। কিন্তু কোনভাবেই দমন করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে মাদকের কুপ্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় একাধিক চুরি ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে। পৌর এলাকার মোঃ আবু সায়েম নামের এক হাইস্কুল শিক্ষক তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, এলাকায় প্রতিনিয়ত একাধিক চুরির ঘটনা ঘটছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে এসব ঘটনার জন্ম বলে তিনি দাবি করেন। ইতিমধ্যে চুরি ও মাদকের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা ও প্রতিবাদসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে রাঙ্গুনিয়া পৌর এলাকার সচেতনমহল। রাঙ্গুনিয়া থানা সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ী চোলাই মদ পাচারকারী চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটের সাহারা খাতুন, গোছরার মাদক বিক্রেতা এক মহিলাসহ অর্ধশতাধিক মদ-ইয়াবা বিক্রেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি মরিয়মনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফ হোসেন প্রকাশ কানা আলতাফ সম্প্রতি দুর্বৃত্তদের গুলিতে মারা যান। সম্প্রতি সাহারা খাতুন জেল থেকে জামিনে এসে আবারও মদ-গাঁজা বিক্রি করছে বলে জানা গেছে। সরফভাটা সিএনজি চালক মোঃ রবিউল হোসেন জানান, রাঙ্গুনিয়ায় মাদকের ভয়াবহতা বৃদ্ধির পিছনে সমাজের দায়িত্বশীল রাঘববোয়ালদের অনেকেই অবৈধ নেশাজাত দ্রব্যের আমদানিকারক হলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। মানবাধিকার কমিশন রাঙ্গুনিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক মাস্টার ইদ্রিছ মিয়া বলেন, সমাজের বা সাধারণ মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে রোধ করার জন্য তাদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার ধারণা তৈরি করা। এখানে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার ব্যাপারে। তারপর সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন, স্কুল-কলেজ এবং গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমে যদি এসব বিষয়ের ক্ষতিকর দিক ও প্রভাব তুলে ধরা হয়, তারা যদি এ ধরনের কাজ যে গর্হিত অপরাধ এবং এটা করা অনুচিত এ বিষয়টিকে প্রচার করেন তাহলে বিষয়টির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে এবং মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে পরিবার ও দেশকে রক্ষা করতে হলে আগে দরকার পরিবারের সচেতনতা।