পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমসহ অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-সংগঠন ও দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
আজ বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা (Aongay Marma) এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান।
বিচার বহির্ভূত হত্যাপার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ভয়াবহ ও দুর্বিসহ আখ্যায়িত করে অংগ্য মারমা বলেন, ‘গত ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি ঠ্যাঙারে বাহিনী (vigilante group) গঠনের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে।’ উক্ত সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইউপিডিএফের ৪৬ জন কর্মি ও সমর্থক বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। ‘এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর হাতে ৮ জন ও তাদের মদতপুষ্ট ঠ্যাঙারে বাহিনীর হাতে ৩৮ জন।
গুম‘আর ঐ সময়ে গুমের শিকার হয়েছেন ৪ জন, যার মধ্যে গত বছর ৯ এপ্রিল ঢাকার অদূরে কাঁচপুর থেকে ইউপিডিএফ-এর মুখপাত্র ও ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স ফ্রন্ট-এর সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমার গুমের ঘটনাটি দেশে বেশ সাড়া জাগায়। তার এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
‘গুমের শিকার বাকি দুই জন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম চট্টগ্রাম ইপিজেড থানা শাখার সভপতি জুনেল চাকমা ও বন্দর থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক কালী শংকর চাকমাকে এক মাস যাবত অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার পর থানায় হস্তান্তর করা হয়। তারা গত ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহর থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। আর ইউপিডিএফের সদস্য সুনেন্দু চাকমা চট্টগ্রামের শেরশাহ থেকে নিখোঁজ হন গত বছরের ২০ আগষ্ট। তাকে দীর্ঘ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার পর গত মাসে (জানুয়ারি) ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এই দুটি গুমের ঘটনায় র্যাব জড়িত ছিল।’
গ্রেফতার ও অপহরণএছাড়া ২০১৮ সালে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের ৫৯ জন ও ২০১৯ সালে ৭৪ জন নেতা, কর্মি ও সমর্থক গ্রেফতার এবং ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেনা-মদতপুষ্ট ঠ্যাঙারে বাহিনী কর্তৃক ১৪৭ জন অপহৃত হন বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর বন্দীর উপর সাধারণত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং বিভিন্ন সাজানো ও মিথ্যা মামলা দেয়া হয় বলে তিনি জানান।
মানবাধিকার পরিস্থিতির অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে অংগ্য মারমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, আদালত কর্তৃক জামিন পাওয়ার পরও লোকজনকে পুনরায় জেল গেট থেকে ধরে নিয়ে আবার জেলে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এমন ঘটনাও বিরল নয়, যেখানে বেশ কয়েকজন হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পরও দুই বা ততোধিক বার এভাবে জেল গেট থেকে পুনঃ গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন।’
আজ পর্যন্ত ইউপিডিএফের ১৯ জন কর্মি ও সমর্থককে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরও জেল গেট থেকে পুনরায় আটক করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। এভাবে পুনঃ গ্রেফতারের পর তাদেরকে পুরোন মামলায় নতুনভাবে জড়ানো হয়।
ভূমি বেদখলপার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখলের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে ইউপিডিএফের মুখপাত্র বলেন, ‘সম্প্রতি ৫ – ১১ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি জেলার নানিয়াচর উপজেলাধীন বেতছড়িতে বহিরাগত সেটলাররা ভূমি বেদখলের চেষ্টা চালায়। এ সময় তাদের হামলায় দুই পাহাড়ি আহত হন।’
পাহাড়ির মালিকানাধীন উক্ত ভূমি বেদখল প্রচেষ্টায় স্থানীয় সেনাবাহিনী সেটলারদের সহায়তা দেয় বলে তিনি জানান।এছাড়া সংবাদ মাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে অংগ্য মারমা বলেন, ‘কেবল মাত্র বান্দরবান জেলার ৮টি মৌজায় ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে প্রায় ২৩০টি জুম্ম পরিবারকে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মূলত বাঙালি বসতিস্থাপন, রাবার বাগান তৈরি এবং পর্যটনের নামেই দখল হয়েছে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর জুম ভূমি। (সূত্র The Daily Star বাংলা, জানুয়ারি ৩০, ২০২০)
‘ভূমি বেদখলের সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যেমন গত ৫ ডিসেম্বর ২০১৯ নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তিন ইউনিয়নের ১১টি পাড়ার মারমা ও চাক সম্প্রদায়ের জনগণ বান্দরবান সদরে এক প্রতিবাদী মানববন্ধনে অভিযোগ করেন যে, ‘নাইক্ষ্যংছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো: শফিউল্লাহ এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা পর্যটনের নামে জুমভূমির শতাধিক একর জমি দখল করছে। (http://chttoday.com/news/4387)
‘বান্দরবানেও ভূমি বেদখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। যেমন গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের আলীকদম উপজেলাধীন সোনাইছড়িতে বহিরাগত ভূমিদস্যুরা স্থানীয় মুরুংদের জমি বেদখলের চেষ্টা চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ৫ জন মুরুং সহ আরো অনেকে আহত হয়।’(https://www.bbcnews24.com.bd/2019/09/11/%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A6%A6%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A7/
তিনি বলেন, ‘ভূমি বেদখলের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা দ্রুত তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাচ্ছে। এতে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার মতো প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান তাদের হাতছাড়া হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে পাহাড়ি-বাঙালির অনুপাত ৯৮:২, সেখানে বর্তমানে এই অনুপাত ৫০:৫০।’
তথাকথিত ‘মগ বাহিনী’অংগ্য মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল বান্দরবানে তথাকথিত ‘মগ বাহিনী’ বা আরাকান লিবারেশন পার্টি নামক একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী একটি বিশেষ কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় বিনা বাধায় ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়ে বেড়াচ্ছে।
জেএসএস নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে. এস. মং মারমার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত এই ‘মগ বাহিনীর’ হাতে ২৪ জন খুন হয়েছেন। বান্দরবান ব্রিগেড অফিস থেকে ১০০ গজের মধ্যে ঘোরাফিরা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘এ সব ঘটনা তুলে ধরার কারণে (কে. এস. মং মারমা ৩ ডিসেম্বর ২০১৯ চ্যানেল ২৪ এর টকশোতে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেন) গত ১২ জানুয়ারি বান্দরবানে কোর্টে হাজিরা দিতে গেলে কে. এস. মং মারমাসহ আট জনকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়েছে।’
নারী নির্যাতনপার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৯ সালে দুই পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। চার জন ধর্ষণ প্রচেষ্টার ও একজন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া আগের বছর (২০১৮) ২০ জন পাহাড়ি নারী ধর্ষণ, গণ ধর্ষণ ও ধর্ষণ প্রচেষ্টার শিকার হন। এদের মধ্যে দুই জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়।
ইউপিডিএফ নেতা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। এ জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দল-সংগঠন এবং দেশ বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।