ঢাকার যানজট ঠেলে যখন আশুলিয়ায় জেবুন নেসা মসজিদের সবুজ উঠানে গিয়ে দাঁড়াই, এক অদ্ভুত আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। কয়েক কদম হেঁটে মসজিদ থেকে বাইরের লেকের দিকে তাকালেই ভুলে যাই, জায়গাটা একটি তৈরি পোশাক কারখানার প্রাঙ্গণ। যান্ত্রিকতার মধ্যে আসলে এমন কিছুই তো নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম।একসময় উঁচু দেয়ালের কারণে কারখানার ভেতর থেকে পাশের লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত না। নকশা করার সময় সীমানাপ্রাচীর ভেঙে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, পশ্চিম পাশের এ লেক আশুলিয়ার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। একসময় এখানে চাষাবাদ হতো। দিনে দিনে শিল্পায়ন হতে হতে এলাকাটার আদি রূপের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পেয়েছি এ লেককে।
মসজিদে প্রথমে যাঁরা যাবেন, এই স্থাপত্যকে তাঁরা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করার অনুভূতি পাবেন। সিঁড়ি বা র্যাম্প বেয়ে ওপরে উঠে চোখে পড়বে চতুর্ভুজ একটি প্যাভিলিয়ন ফর্ম। এই চতুর্ভুজের চারপাশে চারটি বাগান রেখেছি। চারটি বাগানের ভেতর সবচেয়ে বড়টি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সেখানেই বাগানের ভেতর দিয়ে একটা ছাতিমগাছকে ঘিরে চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। ছাতিমগাছটা অনেকটা ছাতার মতো ছায়া দিচ্ছে। সেদিক দিয়ে ওপরে উঠলেই নারীদের নামাজের জায়গা। সেখান থেকে পশ্চিম পাশের লেকটা ভালোভাবে দেখা যায়। চতুর্ভুজ আকৃতির অবয়বের ভেতরে ঢুকলেই গোলাকৃতির বড় গম্বুজটার দেখা মিলবে। গম্বুজের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালে একটা শান্ত–শীতল বিশালত্বের খোঁজ পাই। সামনে তাকালে সেই বিশাল লেক।
মসজিদটা মনোলিথিক আর্কিটেকচারে গড়েছি। মনো মানে এক। মনোক্রোম রঙে বা এক রঙে রাঙা। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা একজন সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। সেই ‘একক’ ব্যাপারটা এই স্থাপত্যেও উঠে এসেছে। সিমেন্ট, রং, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী সব স্থানীয়। মোজাইকে মার্বেলের বদলে ইটের টুকরা ব্যবহার করেছি। কারিগরেরাও সবাই দেশি। মসজিদটিকে তাই আমি বলি ‘লোকালি হ্যান্ড মেড’।
মসজিদের লালচে গোলাপি রংটা এই অঞ্চলের টেরাকোটা, চুনসুরকি ও বাংলার মৃৎ-স্থাপত্যের রং ও টেক্সচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিয়েছি। ইসলামি স্থাপত্যে যে জালির ব্যবহার থাকে, এখানেও রেখেছি। তবে সেটি কেবল দেখার সৌন্দর্যের জন্য নয়; বরং প্রাকৃতিক আলো-বাতাস যথাসম্ভব ভেতরে ঢোকানোর জন্য। তাই মসজিদে কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখিনি। তবে মসজিদের ভেতরে সব সময় লেকের ওপর থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস ফিল্টার হয়ে চলাচলের ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছু প্রজাতির স্থানীয় গাছ লাগানোর ব্যবস্থা রেখেছি। যেমন পশ্চিমে দুটি শিমুলগাছ আছে। সেই সঙ্গে নিচেও আছে লেমনগ্রাস, রেইন লিলিসহ নানা প্রজাতির গাছ। এমনভাবে গাছগুলো বাছাই করার চেষ্টা করেছি, যেন সারা বছর কিছু না কিছু রঙিন ফুল ফুটে থাকে। এ ছাড়া ঢোকার পথে, অজুখানার পাশেসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঁশঝাড় লাগিয়েছি। এই বাঁশঝাড়ের মাধ্যমে গ্রামবাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঢুকে পড়েছে মসজিদ প্রাঙ্গণে।