কল্লোল মোস্তফা
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের শেষ অবলম্বন ৪শ একর ভূমি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। এই ভূমি রক্ষার দাবিতে গঠিত ‘লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ অভিযোগ করেছে- লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি কোম্পানি স্থানীয় ওই জমি জবরদখল করতে চাচ্ছে। অথচ লাংকমপাড়া (ম্রো কারবারি), জয় চন্দ্রপাড়া (ত্রিপুরা) ও রেংয়েনপাড়ার (ম্রো) ৩৯টি পরিবার সেখানে বংশপরম্পরায় বসবাস ও ভোগদখল করে আসছে।
প্রকৃতপক্ষে লামার বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি ম্রো ও ত্রিপুরাদেরই ছিল। সেখানে তারা জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। আর জুম চাষের বৈশিষ্ট্যই এমন- এর জন্য স্থায়ী ব্যক্তিগত ভূমি মালিকানার প্রয়োজন পড়ে না। কোনো একটি পাড়ার আওতায় থাকা জুম চাষের জমি বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং টানা দু-তিন বছর চাষাবাদের পর উর্বরতা পুনরুদ্ধারে সেই জমি কয়েক বছরের জন্য ফেলে রাখতে হয়। এভাবে কয়েক বছর পরপর পাড়ার জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গা এবং প্রতিটি পরিবারের জুমের ক্ষেতও বদলে যেতে থাকে। কিন্তু পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার অগ্রাহ্য করে গত শতকের ‘৮০-‘৯০ দশকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব জমি বাণিজ্যিক প্লান্টেশনের জন্য বহিরাগতদের লিজ দেওয়া হয়। এতে ওই জুম ভূমি থেকে একদিকে ম্রো ও ত্রিপুরার লোকজন উচ্ছেদ হতে থাকে। অন্যদিকে রাবার, টিক ইত্যাদির মনোকালচার প্লান্টেশনের প্রভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে থাকে।
এই ধারাবাহিকতায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ডলুছড়ি ও সরাই মৌজার মোট ১ হাজার ৬০০ একর জমি লিজ দেওয়া হয়। লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ বাস্তবে ৩ হাজার একরেরও বেশি জমিতে রাবার বাগান করেছে। এখন যে ৪০০ একর জমি থেকে ম্রো ও ত্রিপুরাদের উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে; সেটিও লিজের আওতার বাইরের জমি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমি থেকে উচ্ছেদ করতে গত এপ্রিল মাসে তাদের বাগানে লাগানো বিভিন্ন ফলদ চারা যেমন- আনারস, বরই, আম, জাম, কাঁঠাল গাছ, বাঁশবাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে দেওয়া হয় এবং জমিতে আগুন দিয়ে ফসল ধ্বংস করে তাদের খাদ্য সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। জুম ভূমিতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বান্দরবান জেলা পরিষদের পরিদর্শন কমিটির গত ১৯ মে দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, ওই ৪শ একর জমি যদি ১৯৯৬ সালে দেওয়া লিজের আওতায় পড়েও থাকে; ৫ বছরের মধ্যে রাবার বাগান সৃজনের শর্ত ভঙ্গের কারণে সেখানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের আইনগত অধিকার এখন আর নেই। যে কারণে পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনে লিজ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছিল। মে মাসের সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের অপতৎপরতাও বন্ধ হয়নি। বরং জুলাই মাসে ভূমি রক্ষা কমিটির ওপর সন্ত্রাসী হামলা এবং আগস্ট মাসে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়। সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর মাছ শিকারের নামে সরই ইউনিয়নের রেংয়েনপাড়ার বাসিন্দাদের সুপেয় পানির প্রধান উৎস কালাইয়া ঝিরিতে কীটনাশক ছিটানো হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য, সেখানে বসবাসরতদের জমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা।
দুই.
ভূমির অধিকার হারাতে হারাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীরও অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। তাদেরও ঐতিহ্যবাহী যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা; জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার কাগজপত্র থাকে না। কাগজপত্র থাকলেও জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে প্রভাবশালীরা সেই জমি আত্মসাৎ করে। যেমন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকার সাঁওতালদের ভূমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার হুকুমদখল করেছিল রংপুর চিনিকলের আখ চাষের জন্য। শর্ত ছিল, আখ চাষ না হলে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই জমিতে আখ চাষ বন্ধ হয়ে গেলেও শর্তমতে জমি ফিরিয়ে না দিয়ে সেখানে ইপিজেড নির্মাণের তৎপরতা চলছে। আরও উদাহরণ আছে। সম্প্রতি ‘সাঁওতালদের জমি ও জীবনরক্ষা আন্দোলন’ এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে, দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও তাঁর চাচা ‘স্বপ্নপুরী’ নামে বিনোদন কেন্দ্রের জন্য সাঁওতালদের ভূমি দখল করছেন। প্রায় ৩০০ একর ওই জমিতে সাঁওতাল ও মাহালি সম্প্রদায়ের তিনটি কবরস্থানও আছে।
তিন.
মধুপুর বনের ৪৪টি গ্রামে ২০১৭-১৮ পর্যায়ে বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) পরিচালিত এক জরিপ অনুসারে, মধুপুর বনে কয়েকশ বছর ধরে বাস করলেও ৯৬ শতাংশ মান্দি বা গারোরই ভূসম্পত্তির কোনো দলিল নেই। বন বিভাগ কিংবা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেরও জন্মের বহু আগে থেকে গারো-কোচ-বর্মণ জনগোষ্ঠী মধুপুর অঞ্চলে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে প্রচলিত প্রথাগত ভূমি অধিকারের আইনি স্বীকৃতি না থাকার অজুহাতে বন বিভাগ তাদের বসবাস ও চাষাবাদ ভূমিকে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ ঘোষণা করে। তারা এখন নিজভূমেই বহিরাগত বা অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত। সম্প্রতি বন বিভাগ মধুপুরে চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম লেক খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিহাসের বিষয়, এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্থানীয় ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা’। প্রকল্পের জমিতে গারো জনগোষ্ঠীর ১৩টি পরিবারের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ওই জমির খাজনার কাগজপত্র থাকলেও এসবের কোনো মূল্য নেই। বন বিভাগ সেখানে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ লেখা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তিন ফসলি জমিতে কৃত্রিম লেক খননের কর্মকাণ্ড স্পষ্টতই স্থানীয় আদিবাসীর জীবন-জীবিকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশের ওপরেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
চার.
ওপরের তিনটি ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র ভিন্ন হলেও কিছু সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা প্রান্তিক, দরিদ্র ও অবাঙালি নৃগোষ্ঠীর সদস্য। তাদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের আইনি স্বীকৃতি না থাকার সুযোগ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাগজপত্র থাকলেও জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ভূমি দখল করা হচ্ছে। শুধু বান্দরবানের লামা, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ বা মধুপুর বনাঞ্চলই নয়; দেশে এমন আরও এলাকা রয়েছে, যেখানে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী বংশপরম্পরায় বসবাস ও চাষাবাদ করে এলেও তাদের কাছে ভোগদখলি জমির ‘আইনি মালিকানা’ নেই। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কখনও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, কখনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা বেসরকারি কোম্পানি সেসব জমি দখলের অপতৎপরতা চালায়। মালিকানার কাগজপত্র থাকলেও জালিয়াতি বা বল প্রয়োগে উচ্ছেদের তৎপরতা চলে। তখন ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায় না। প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে বরং উচ্ছেদেই সহায়তা করে থাকে। আলোচ্য ভুক্তভোগীদের বসবাস ও চাষাবাদের জমির অধিকার সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রথাগতভাবে ব্যবহার হওয়া এসব জমিতে ভবিষ্যতেও বাণিজ্যিক ও ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প, ইজারার উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে যৌথ মালিকানা ব্যবস্থায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ভূমি অধিকারের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক, প্রকৌশলী, নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা
সূত্র: সমকাল