পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান তিন শর্ত ও জেএসএসের ভূমিকা

প্রিতম বড়ুয়া অসি।।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর প্রায় ২৫ বছর হতে চলেছে, কিন্তু তারপরও এখনও তা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। জেএসএস নেতৃত্ব প্রথমদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী ছিল এবং ‘আদিবাসী-বান্ধব’ (তাদের ভাষায়) আওয়ামী লীগের উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেছিল (বোকার মত)। লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম, শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন’ বইয়ের (প্রথমা প্রকাশন ২০২২) নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে তা বোঝা যাবে। তিনি লেখেন:

‘পার্বত্য চুক্তি নিয়ে সাংবাদিক সালিম সামাদের আগ্রহ ছিল। এক সাক্ষাতকারে বিবিসিকে তিনি বললেন — সরকার এই চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না। এর কয়েকদিন পর ঢাকায় আদিবাসীদের নিয়ে একটা সেমিনারে সালিম সামাদের দেখা হলো সন্তু লারমার সঙ্গে। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে সন্তু লারমা অনুযোগ করলেন — আপনারা শুধু শুধু এ নিয়ে নানান কথা বলেন। আমি এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে খুব আশাবাদী।’

কিন্তু সন্তু লারমার আশাভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। ১৯৯৯ সালের ৩০ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চার দিনব্যাপী ৬ষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন শুরু হয়। এটা ছিল জনসংহতি সমিতির প্রথম প্রকাশ্য জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন অমিয় সেন চাকমা। প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মেলন উদ্বোধন করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন, চুক্তি সই করা ছিল ‘বিরাট ভুল’। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ‘সৎ উদ্দেশ্যে’ নয়, বরং জুম্ম জনগণের সঙ্গে বেঈমানি করার জন্য চুক্তি সই করেছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপন করছে। (পৃ: ৪৩৭, দি ডেইলী স্টার ৩ নভেম্বর ১৯৯৯)

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন সরকারের পক্ষে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির পক্ষে সন্তু লারমা।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, চুক্তি স্বাক্ষর করা এক জিনিস, আর তার বাস্তবায়ন আদায় করা অন্য জিনিস। শাসকগোষ্ঠী প্রথমে চায় নিপীড়িত জনগণের আন্দোলজন গড়ে না উঠুক। যখন আন্দোলন গড়ে ওঠে, তখন তারা চায় তা দমন করতে। যখন দমন করতে ব্যর্থ হয়, তখন চায় কম ছাড় দিয়ে আন্দোলন থামাতে। এ জন্য তাকে চুক্তি করতে হয়। আবার চুক্তির পর তারা চায় চুক্তির মাধ্যমে যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা পুরো না দিতে, যদি সেটা না পারে, তাহলে সামান্য কিছু দিয়ে বশ করতে।

এই অবস্থায় জনগণের করণীয় কী? এর উত্তর দেয়ার আগে জানা দরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কী কী শর্ত থাকতে হবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানত তিনটি শর্তের উপস্থিতি দরকার, সেগুলো হলো:

১। জুম্ম জনগণের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করে ব্যাপক গণআন্দোলন। এর জন্য প্রয়োজন ইউপিডিএফ ও জেএসএসের (উভয় অংশ) মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য। জুম্ম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ছাড়া সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়।

২। আন্দোলনে দেশের বাঙালি প্রগতিশীল দল, সংগঠন ও ব্যক্তির এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন।

৩। শাসক আওয়ামী লীগ বা সরকারের নীতির পরিবর্তন।

উক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথম শর্তই প্রধান। এই প্রথম শর্ত পূরণ হলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্তও সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ যদি জুম্ম জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালাতে থাকে, তাহলে বাঙালি প্রগতিশীল শক্তির ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভের শর্ত তৈরি হবে এবং ১ নং ও ২ নং শর্তের চাপে পড়ে ৩ নং শর্ত বাস্তব হয়ে উঠবে অর্থাৎ সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আসবে।

কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব কি ১ নং শর্ত সৃষ্টি করতে প্রস্তুত? অর্থাৎ জেএসএস নেতৃত্ব কি ইউপিডিএফের সাথে জোট বা ফ্রন্ট গঠন করে গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রস্তুত? তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ দেখে আপাতত তা মনে হয় না। কেন জেএসএস নেতৃত্ব আন্দোলনে যেতে চায় না? যেতে চায় না, কারণ আন্দোলনে গেলে তাদের আঞ্চলিক পরিষদের গদি হারানোর ভয় রয়েছে। সে ভয়ে তারা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ইউপিডিএফ ও জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনে যেতে চায় না। জেএসএস নেতৃত্ব আঞ্চলিক পরিষদে ঠুটো জগন্নাথের মতো থাকতে প্রস্তুত, কিন্তু তারপরও চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করতে রাজী নয়। গত ২৫ বছরে তারা চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকার ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে নাকি সুরে কান্না করলেও, কার্যকর কোন আন্দোলন করেনি, আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও করেনি। ২০০৪ সালে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে লোকদেখানো টুকিটাকি কিছু কর্মসূচি পালন করলেও খাগড়াছড়িতে তাদের কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলে আন্দোলন বন্ধ করা হয়। সে পর থেকে আর কোন কর্মসূচি জেএসএস দেয়নি।

কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন না করলেও জেএসএসের নেতৃত্ব বসে থাকেনি। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য তাদেরকে শত্রু সৃষ্টি করতে হয়। যেহেতু তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যেতে ভয় পায়, তাই তারা ইউপিডিএফকে শত্রু হিসেবে বেছে নেয়। তাদের নেতাকর্মীদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে তাদেরকে লেলিয়ে দেয়। অথচ ইউপিডিএফের উপর আক্রমন করার কোন যুক্তি জেএসএসের নেই। নিজের গদি রক্ষা করা, নেতৃত্বের দুর্বলতা ঢেকে রাখা ও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব এড়ানোর জন্যই জেএসএসের শীর্ষ নেতা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের আশ্রয় নিয়েছে। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের সময় রাজা ষোড়শ লুই নিজে বাঁচার জন্য ও সিংহাসন রক্ষার জন্য তার দেশের শত্রু রাজ্যের (অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া) সাথে আঁতাত করতে কুণ্ঠিত হননি। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে জনগণ আটক ও পরে হত্যা করে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে গণবিরোধী, দুর্নীতিবাজ রাজা, শাসক ও নেতাদেরকে ষোড়শ লুইয়ের মতো ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। জেএসএস নেতৃত্বও এখন নিজে বাঁচার জন্য জাতি ও জনগণকে ধ্বংস করার সরকারী মহাপরিকল্পনায় অংশীদার হয়েছে। এক সময়ের প্রগতিশীল জেএসএস আজ চরম প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

এই অবস্থায় জনগণকে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর ছাত্র যুব সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপনারা কী অপরিণামদর্শী জেএসএস নেতৃত্বের চাপিয়ে দেয়া ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জুম্ম জাতিকে তিলে তিলে ধ্বংস হতে দেবেন, নাকি জাতি ও জনগণকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। যদি জুম্ম জাতিকে ভালোবাসেন, তাকে রক্ষা করতে চান, তাহলে আপনাদেরকে অবশ্যই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, সংঘাত বিরোধী শক্তির সাথে একত্রিত হতে হবে। এভাবে যখন সংঘাত বিরোধী শক্তি শক্তিশালী হবে তখন আন্তঃজুম্ম সংঘাত বন্ধ হবে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শর্ত সৃষ্টি হবে। মনে রাখতে হবে জাতি ও জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল রাজনৈতিক দলের নয়, এ দায়িত্ব জনগণেরও এবং বিশেষ করে শিক্ষিত ছাত্র যুব নারী সমাজের।#

১৮.০৮.২০২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *