পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাড়াটে সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ও সেনাবাহিনীর অপপ্রচার প্রসঙ্গে

আবুমং মারমা

মগ লিবারেশন পার্টি, সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এই তিনটা দল হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাড়াটে সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ছাড়া আর কিছু নয়। তারা ভাড়াটে সন্ত্রাসী এই কারণে যে, কার্যত তাদের দলের কোনো নীতি-আদর্শ নেই। তাদের কোনো জনসমর্থন নেই। তারা আছে সেনাবাহিনীর অর্থবল ও অস্ত্রবলের জোরে। এর পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামীলীগের সহযোগিতায়। এছাড়া নিরীহ জনগণের কাছ থেকে নির্মমভাবে চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায় করে।

সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্তৃক ‘মগ লিবারেশন পার্টি’র সন্ত্রাসীদের বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায়, বিশেষ করে তারাছা ইউনিয়ন বা বেতছড়া মৌজা এলাকায় মোতায়েন করিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিন-চার বছর আগে বেতছড়া এলাকায় মগ পার্টির কথা ভিতরে ভিতরে শোনা গেলেও এবারে তারা প্রকাশ্যে তৎপর হয়েছে। অপরদিকে স্থানীয় কিছু নীতিভ্রষ্ট যুবকও টাকার লোভে মগ পার্টির দলে যোগদান করেছে বলে জানা গেছে। মাঝে মাঝে বেতছড়া বাজারে মগ পার্টির সদস্য ও সংস্কারপন্থী দলের সদস্যরা এক দোকানে বসে আড্ডা মারে বলে জানা গেছে।

গত ১৩ মার্চ ২০২২ তারিখে হিল ভয়েস-এ বান্দরবানে মগ পার্টিকে দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠক বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত বৈঠকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর বান্দরবান জেলা সভাপতি মংপু হেডম্যান এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লা মারমা’র প্রতিনিধি হিসেবে তিন হেডম্যান উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। এছাড়া রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হ্লাথোয়াইহ্রী মারমাও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।

উল্লেখ্য, বেতছড়া এলাকার আওয়ামীলীগকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে হ্লাথোয়াইহ্রী মারমা। দুই-তিন বছর আগেও কতিপয় স্থানীয় আওয়ামলীগের নেতাকর্মীর নেতৃত্বে বেতছড়া এলাকায় মগ পার্টির সন্ত্রাসীদের আনা হয়। এবং তাদের থাকা ও খাওয়ার জন্য চাউলের ব্যবস্থা করা হয়। তখনও তারা (স্থানীয় আওয়ামীলীগ) যে উদ্দেশ্যে মগ পার্টিকে এনেছিল তাতে তারা সফল হতে পারেনি। ইদানিং হ্লাথোয়াইহ্রী মারমার নিজ এলাকায় মগ পার্টির একটি সশস্ত্র দল অবস্থান করছে বলেও জানা যায়।

সম্প্রতি সেনাবাহিনী এবং তাদের তিন ভাড়াটে সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা বেতছড়া এলাকায় প্রচার করতে শুরু করেছে যে, তাদের তিনটি দল এবং সাথে সেনাবাহিনী মিলে পিসিজেএসএসকে পাহাড় থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা আরো বলছে যে, ‘আমরা তিনটি দল এক হয়েছি। আমাদের সাথে আর্মিরা আছে। আমাদের শক্তি বেশি। পিসিজেএসএস তারা দুর্বল। তারা আমাদের সাথে পারবে না। তাই সময় থাকতে তোমরাও (গ্রামবাসীদেরকে) আমাদের দলে যোগ দাও।’ সেনাবাহিনী ও তিন ভাড়াটে সন্ত্রাসী দলের এই যে অপপ্রচার সেটা সেনাবাহিনীরই শেখানো অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।

বস্তুত যে চুক্তিবিরোধী কাজগুলো সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে করতে পারে না, সেনাবাহিনী সেগুলো এই তিনটি ভাড়াটে সন্ত্রাসী দলের সদস্যদের দিয়ে করিয়ে নেয়। তাদের কাজ হল- পিসিজেএসএস’এর নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তাবায়নের আন্দোলনসহ যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন চলছে তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা। এক কথায়, পিসিজেএসএস’এর নেতৃত্বে জুম্মজাতির যে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন চলছে, তার বিরুদ্ধে কাজ করা। এছাড়া আর কিছুই নয়।

বলাবাহুল্য, এইসব আদর্শহীন ভাড়াটে সন্ত্রাসী দল দিয়ে পিসিজেএসএস’কে এবং তার চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দালনকে ধ্বংস করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পিসিজেএসএস অবশ্যই শক্তিশালী এবং পিসিজেএসএস ক্রমাগত তার শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধি করে চলেছে। কারণ তার সুনির্দিষ্ট নীতি-আদর্শ আছে। রয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং কর্মপদ্ধতি। সর্বোপরি রয়েছে জনগণের অকুণ্ঠ ও আন্তরিক সমর্থন। সে কারণেই শত ষড়যন্ত্র ও বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জুম্মজাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর শত ষড়যন্ত্রও দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর পারবেও না।

যেদিন থেকে পাহাড়ের বুকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জন্ম হয়েছে এবং তার নেতৃত্বে জুম্মজাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও জন্মভূমি সংরক্ষণের আন্দোলন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়েছে সেদিন থেকে পিসিজেএসএস’এর বিরুদ্ধে, তার আন্দোলনের বিরুদ্ধে, জুম্মজাতির একতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র তথা সেনাবাহিনী অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি এবং পারবে না।

আজকাল বান্দরবান সদরে প্রকাশ্যে এবং প্রশাসনের নাকের ডগায়, উক্ত সন্ত্রাসী দলগুলো অবস্থান করছে এবং চাঁদা তুলছে। বান্দরবান সদরের বালাঘাটায় যেখানে ইউপিডিএফ এর কার্যালয় ছিল সেখানেই এখন গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এর কার্যালয়। অপরদিকে বান্দরবান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এলাকার থানচি বাস ষ্টেশন এলাকায় রয়েছে সংস্কারপন্থীদের অবস্থান। এছাড়া কালাঘাটায় উক্ত উভয় দলই অবস্থান করে।

রবিবার আর বুধবার হচ্ছে বান্দরবান সদরে বাজার দিন। বেতছড়া বাজার থেকে বান্দরবান বাজার গেলে প্রতি রবিবারে প্রতি নৌকা(বোট) থেকে এবং ব্যবসায়ী থেকে সংস্কারপন্থীদের চাঁদা দিতে হয়। বড়ইতলি গ্রামের নিচে থেকেও সংস্কারপন্থীরা চাঁদা তুলে থাকে। বেতছড়া বাজার ও ক্যাচিংঘাটা বোট সমিতি থেকেও বাৎসরিক হিসাবে চাঁদা নেয়া হয়ে থাকে।

কয়েকদিন আগে বান্দরবান থেকে ১১টি বোটে (বার্মিজ মেশিন বোট) করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রুমার দিকে গিয়েছিল। তাদের সাথে মগ পার্টি, সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের সশস্ত্র সদস্যরাও ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়। বর্তমানে মগ পার্টি দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রুমা এলাকায় অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীই তাদেরকে এলাকা ভাগ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।

১৮ মার্চ ২০২২ বিকালে বান্দরবান হিলভিউ কনফারেন্স হলরুমে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), জেলা কমিটির সভাপতি মংপু মারমার (হেডম্যান) সভাপতিত্বে বান্দরবানের ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে ব্যানারে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর উদ্যোগে দেখানো হলেও মগ পার্টি ও সংস্কারপন্থী দলের সদস্যরাও উপস্থিত থাকে। উক্ত অনুষ্ঠানে তিনটি দল একযোগে পিসিজেএসএস’এর বিরুদ্ধে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানা যায়। আর এসবকিছুর পেছনে নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করে সেনাবাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *