উথৈইয়া মারমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গত জুন মাসে হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম চারটি গ্রামেই ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয় ১০ জনের। তারা সবাই ম্রো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় এমন মৃত্যুর ঘটনা দুর্গম পাহাড়ে নতুন নয়।
পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সুবিধা থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। আর যৌথভাবে ব্যবহারসহ ৭৮ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে। তবে পার্বত্য এলাকার দুর্গম পাহাড়ের বাস্তবতা ভিন্ন। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মনোআদাম গ্রামের জুমচাষি প্রিয়ময় চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, বছরে ছয় মাস খাওয়ার পানির জন্য চরম কষ্ট করতে হয়। দুই থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে ছোট ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। দুই কলস পানি আনতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে।
পাহাড় ও সমতলের ২৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার চিত্র উঠে এসেছে কাপেং ফাউন্ডেশনের জরিপে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলা ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড স্যোশিও ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অব ইনডিজিনাস পিপলস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই জরিপের ফল শিগগিরই অনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫২ শতাংশ মানুষের সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন (শৌচাগার) সুবিধা নেই।
ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানি ও স্যানিটেশনে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্জন থাকলেও নৃগোষ্ঠীর মানুষ সেই সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।’বিজ্ঞাপন
সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশের অর্জন এখন বিশ্বস্বীকৃত। কিন্তু দেশের ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুবিধায় পিছিয়ে আছে। করোনার প্রকোপ এসব মানুষকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার (৯ আগস্ট) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়: আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান’। ২০৩০ সালে শেষ হতে যাওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মূল স্লোগানের সঙ্গে মিলিয়ে এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে। এসডিজির মূল স্লোগান ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও এসডিজি বিষয়ক নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, দেশের জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটলে ‘কাউকে পেছনে’ না রাখার প্রত্যয় কখনই ফলপ্রসূ হবে না। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য মুখে অনেক কথা বলা হলেও নৃগোষ্ঠীর মানুষের অবস্থার ধারাবাহিক মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বিভাজিত তথ্যও নেই।
জাতিসংঘ ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণ করে। এটি ১৫ বছর মেয়াদি। এতে ১৭ লক্ষ্য ও ১৬৯ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম। সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করাও একটি লক্ষ্য।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৃগোষ্ঠীর মানুষের কার কী অবস্থা, সে সম্পর্কে তথ্য খুব প্রয়োজন। কিন্তু তা আমাদের হাতে নেই। সার্বিক উন্নয়নকাজের সুফল তারা নিশ্চয়ই পায়। তবে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিশ্চয়ই দরকার। আর এ বিষয়টি নিয়ে আমরা অবশ্যই ভাবব।’
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অবস্থা এখন কেমন? সরকারের কোনো দলিলে জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক কোনো উপাত্ত নেই। এ বিষয়ে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, সমস্ত নিরিখেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অনেক পিছিয়ে। এ থেকে উত্তরণে সরকারের দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যায় না।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে দারিদ্র্যের হার ৫৩ থেকে ৬৩ শতাংশ। এ হার জাতীয় গড়ের দ্বিগুণের বেশি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পাহাড়ের এসব তথ্য থাকলেও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সম্পর্কে কোনো উপাত্ত নেই। সরকার ২০১৯ সালে দেশের যে ৫০টি জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার মধ্যে সমতলেরই ৩৯টি। পাহাড়ে এখন বাঙালির সংখ্যা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। যে ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সেখানে আছে, তাদের কার অবস্থা কেমন, তার কোনো স্পষ্ট চিত্র ওই দলিলে নেই।
করোনাকাল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে বিপদে ফেলেছে। গত বছর আগস্ট মাসে বেসরকারি সংগঠন ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে এক গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, ৯২ ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে দরিদ্র হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে নৃগোষ্ঠীর মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য পৃথকভাবে কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।