ইতিহাসে এই দিন : স্বাধীন ‘পার্বত্য রাজ্যকে’ জেলায় রূপান্তর করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা

০১ আগস্ট, ইতিহাসে এই দিন :

আজকের পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক ভূ-খণ্ডটি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাস্তবত বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও স্বশাসিত রাজ্য ছিল। ক্যাপ্টেন লুইন স্বীকার করেছেন ১৮২৯ সাল পর্যন্ত এ রাজ্য ছিল ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত স্বাধীন। ১৮২৮ সালের ২১ এপ্রিল চট্টগ্রামস্থ ব্রিটিশ কমিশনার হল হেড এ অঞ্চলের প্রতিবেদন দিতে গিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন,‘পাহাড়িরা ব্রিটিশ প্রজা নয়, কর দাতা মাত্র। তাদের ওপর আমাদের (ব্রিটিশদের) কর্তৃত্বের কোন অধিকার নেই।’

কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই, ১৮৬০ সালের ১ আগস্ট তথাকথিত এক আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা স্বাধীন এ ভূ-খণ্ডটিকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নাম দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেয়। ধূরন্ধর ঔপনিবেশিক শাসকরা একে অভিহিত করেছিল ‘জেলায় উন্নীতকরণ’ বলে, যা ছিল যারপরনাই প্রতারণা ও মিথ্যাচার। এ সময় পার্বত্য রাজ্যের শাসক ছিলেন তেজস্বিনী রাজ মহিয়সী চাকমা রাণী কালিন্দী রাণী (১৮৩২-১৮৭৩)। জীবদ্দশায় তিনি কখনই নিজ শাসন কার্যে ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও খবরদারি মেনে নেননি। ১৮৬০ সালের এ দিন (১ আগস্ট) আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্রাজ্যভুক্ত করলেও, এ রাজ্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ একযুগেরও বেশী সময়।

স্মর্তব্য যে, কালিন্দী রাণীর পূর্বসূরীগণ এ অঞ্চলের স্বাধীন মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে দীর্ঘ দু’যুগেরও (১৭৭২-১৭৯৮) বেশী সময় গৌরবোজ্জ্বল প্রতিরোধ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রাজা শের দৌলত খাঁ, সেনাপতি রুণু খাঁ, যুবরাজ জান বক্স খাঁসহ আরও ক’জন ছিলেন এ প্রতিরোধ যুদ্ধের বীর নায়ক। তাদের মধ্যে অসম সাহসী ও বিচক্ষণ সেনাপতি রুণু খাঁ প্রবাদ প্রতিম হয়ে রয়েছেন। গেরিলা কায়দায় পারদর্শী পাহাড়ি যুবকদের প্রতিরোধ লড়াইয়ে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ঔপনিবেশিক শাসকরা পার্বত্য রাজ্যের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। সমঝোতার লক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস চাকমা রাজা জান বক্স খাঁ’কে কোলকাতায় আমন্ত্রণ জানান। ১৭৮৫ সালের ফেব্রুয়ারির কোন এক দিন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে  উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা যে চুক্তির শর্ত পালন করেনি।

তথাকথিত আইন জারির মাধ্যমে ‘জেলায় উন্নীতকরণের’ দোহাই পেড়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ১৭৭৩ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত দীর্ঘ একশত চুয়াত্তর বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে চালিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮৬০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শাসনভুক্ত করলেও, কালিন্দী রাণীর মৃত্যুর পরই কেবল ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়। উপনিবেশিক দখলদারিত্ব কায়েম হওয়ার পর রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে এ অঞ্চলকে ব্রিটিশরা জেলা, মহকুমা, সার্কেল, মৌজা ইত্যাদিতে পুনর্গঠন, বিভক্ত এবং ইচ্ছামত সীমানা নির্ধারণ-পুনঃনির্ধারণ করেছিল, যা স্পষ্টতই তাদের খেয়াল-খুশী মত, তাতে স্থানীয় অধিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা করেনি। প্রশাসনিক পদগুলোর নামেও এনেছিল নানা পরিবর্তন। নিজেদের উপযোগী করে প্রবর্তন করেছিল নানা আইন-কানুন বিধি বিধান।

ব্রিটিশ কর্তৃক তথাকথিত “জেলায় উন্নীতকরণ”-এর সময় এ পার্বত্য রাজ্যের আয়তন ছিল ৬,৭৯৬ বর্গমাইল। যা ১৭৬৩ সালে হ্যারি ভার্ললেস্ট জারিকৃত ফরমান অনুযায়ী এ অঞ্চলের সীমানা (উত্তরে ফেনী, দক্ষিণে সাঙ্গু, পশ্চিমে নিজাম রোড (বর্তমান ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড) ও পূর্বে কুকি রাজ্য (বর্তমান মিজোরাম ও বার্মার চিন স্টেট) থেকে আয়তনে বহু গুণ সংকুচিত।

ধোঁকাবাজি প্রতারণা এখানেই শেষ নয়, লুসাই অভিযানের (১৮৯৩) সফল সমাপ্তির পর সাময়িকভাবে এ অঞ্চলের রণনৈতিক গুরুত্ব কমে গেলে, ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে আরেক দফা অবনমিত করে। ‘জেলা’ মর্যাদা থেকে অবনত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করা হয় ‘মহকুমায়’, যা এখনকার উপজেলা সমপর্যায়ের। এ সময় চাকমা অধ্যুষিত ডেমাগ্রি এলাকা মিজোরামের সাথে জুড়ে দিলে এ জেলার আয়তন দাঁড়ায় ৫,১৩৮ বর্গমাইলে। বাংলাদেশ আমলে ফৌজি শাসক এরশাদের তথাকথিত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালে রামু উপজেলা কক্সবাজারের সাথে যুক্ত করার ফলে বর্তমানে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি জেলা নিয়ে এর আয়তন ধরা হয় ৫,০৯৩ বর্গমাইল।

অন্যায় শাসন-শোষণ ছাড়াও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের বহুবিধ গুরুতর ক্ষতি সাধন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় আইন লংঘন করে শতকরা ৯৮ ভাগ অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুক্ত করে দিয়েছিল উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সাথে। তারপর পাহাড়ি জনগণের জীবনে নেমে আসে আরেক অন্ধকার যুগ! কাপ্তাই হ্রদের ক্ষত না শুকাতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, পাহাড়ি জনগণ যেন ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে নিক্ষিপ্ত হয় জ্বলন্ত উনুনে’। নিপীড়ন নির্যাতনের মাত্রা অতীতের সকল রের্ক্ড ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী শাসকচক্র “জ্বালাও পোড়াও নীতি” অবলম্বন করে পাহাড়ি জনগণকে বংশপরম্পরার বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের ধ্বংসাত্মক নীতি জারি রেখেছে। পাহাড়িদের ন্যায্য অধিকার পূরণ বা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র্য মেনে নেয়া দূরের কথা, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দলিল সংবিধান থেকেও জাতিসত্তার পরিচিতি মুছে দিয়ে “বাঙালি জাতীয়তা” চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। নিজেদের অন্যায় শাসন-শোষণ-নিপীড়ন স্থায়ী করতে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি করেছে তাঁবেদার দালাল। এরাই এখন শাসকচক্রের হয়ে পাহাড়ি জনগণের অনিষ্ট সাধনে লিপ্ত রয়েছে। বলতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এক কঠিন দুঃসময় পার করছে!

পতন দশা থেকে উঠে দাঁড়াতে ব্যক্তিকে যেমন ভর করতে হয় লাঠি, তেমনি দুর্দশাগ্রস্ত জাতি-সমাজকেও অবলম্বন করতে হয় অতীতের সাফল্য বীরত্ব গাঁথা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধের পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধ হচ্ছে্‌ এমনই এক গৌরবোজ্বল অধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *