প্রিতম বড়ুয়া অসি
গত ২২-২৩ বছর ধরে জুম্মদের নিজেদের মধ্যে হানাহানি চলে আসছে। এই সংঘাত আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। প্রায় প্রতিদিন সশস্ত্র সংঘর্ষ ও মৃত্যুর খবরে পত্রিকার পাতা ও অন লাইন নিউজ পোর্টালগুলো সরগরম হয়ে ওঠে। এই আন্তঃজুম্ম সংঘাতে যেসব ক্ষতি হয় তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলঃ
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প তুলে নেয়ার কথা আছে, যদিও কতদিনের মধ্যে এটার বাস্তবায়ন করা হবে তার উল্লেখ নেই। জুম্মদের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকলে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার একটা অজুহাত পেয়ে যায়। তারা সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের “দমনের” জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত থাকার বৈধতা সৃষ্টির সুযোগ পায়। এজন্য তারা নানাভাবে ও নানা কৌশলে জুম্মদের মধ্যে সংঘাত জারী রাখার চেষ্টা চালিয়ে থাকে।
২। সংঘাত চলতে থাকলে জনগণের ইস্যুগুলো (যেমন : ভূমি সমস্যা, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া, নারী নির্যাতন, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন) চাপা পড়ে যায়। তাদের নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দগুলো প্রধান হয়ে ওঠে, নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষভাব, হিংসা, শত্রুতা বেড়ে যায়।
৩। জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরী হয়। তারা আন্দোলনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে।
৪। শাসক গোষ্ঠী জনগণের উপর নিপীড়ন করার সুযোগ পায়। নিরীহ জনগণকে ও সাধারণ পার্টি সদস্যকে হত্যা মামলা, অস্ত্র মামলা, অপহরণ মামলায় জর্জরিত করে। ‘সন্ত্রাসী’ ধরার নামে অপারেশন চালায়, রেইড করে, আর এতে নিরীহ মানুষ হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়।
৫। শাসক গোষ্ঠী জুম্ম দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। এক পক্ষকে অপর পক্ষের বা দলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। ফলে জনগণের পক্ষের শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে যায়। আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়।
৬। জুম্মদের আন্তঃ সংঘাতের সুযোগ নিয়ে শাসক গোষ্ঠী বহিরাগত বাঙালি সেটলারদের দিয়ে ভূমি বেদখল জোরদার করে। তাদের ভিত্তি মজবুত করে। গত ২৩ বছর ধরে চলা সংঘাতের সময়ই শাসক গোষ্ঠী রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ও বান্দরবান জেলা সদরগুলোতে হাজার হাজার বহিরাগত বাঙালীকে কৌশলে নিয়ে এসে পুনর্বাসন করে। ফলে এই তিন পৌরসভাগুলোতে এখন আর কোন পাহাড়ির পক্ষে নির্বাচিত হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই। এখানে বাঙালিরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। মনে রাখতে হবে তিন জেলা সদর হলো তিন জেলার মূল কেন্দ্র। কেন্দ্র দখল করা মানেই অনেক কিছু নিজের দখলে নেয়া।
৭। সংঘাতের কারণে সাধারণ জুম্মরা এবং বিশেষত উঠতি ব্যবসায়ী শ্রেণীগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেদের মধ্যে মারামারির জন্য দলগুলোকে অস্ত্র কিনতে হয়। আর এ টাকা যোগাতে হয় সাধারণ নিরীহ মানুষকে। এটা হলো নিজেদের টাকায় নিজেরা ধ্বংস হওয়া।
৮। শাসক গোষ্ঠী জুম্ম দলগুলোকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’ ও ‘অপরাধী’ হিসেবে চিত্রিত করার সুযোগ পায়।
৯। জুম্মদের আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহানুভূতি কমে যায়। যেখানে জুম্মদের মধ্যেই আন্দোলন নেই, সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের প্রশ্নই আসে না।
১০। সংঘাতের কারণে জুম্মদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হতাশা-নিরাশায় ভুগে অনেকে সর্বনাশা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
এত ক্ষতির পরও যারা সংঘাত চায়, যারা গুলি চালিয়ে নিজের ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা করে দিতে চায়, তারা কি আসলেই জুম্মদের অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে ইচ্ছুক? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন যার উত্তর আমাদের জানা দরকার।
এই অবস্থায় প্রত্যেক জুম্মর আশু ও জরুরী কর্তব্য হলো শাসক গোষ্ঠীর “জুম্মদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জারী রাখার” নীতিকে জুম্মদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার নীতি দিয়ে বিরোধীতা করা এবং পরাজিত করা।