আধুনিক জমিদারদের কবলে লামার ম্রো-ত্রিপুরা

থুইক্যসিং মারমা

ছবি: সমকাল

বর্তমান বাংলাদেশে সেই জমিদারি প্রথা আর নেই। ১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে এই প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের এক ভিন্ন জগৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন নতুন করে জমিদারি ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। এখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে ‘জমিদাররা’ খাজনা খাদক নয়; তারা হলো সাবেক সরকারি আমলা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী; এমনকি রুপালি পর্দার নায়ক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নয়া জমিদারি ব্যবস্থার সূচনা হয় ১৯৮০ সালে, যখন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব ভূমিব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে রাবার বাগান ও হর্টিকালচারের জন্য পাহাড়িদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন জমি বহিরাগতদের কাছে লিজ দিতে শুরু করে। প্রধানত বান্দরবান সদর, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম- এই চার উপজেলায় জমি লিজ দেওয়া হয়। লিজপ্রাপ্তদের মধ্যে গুটিকতক ছাড়া সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাসিন্দা। বর্তমানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে যে একটি কোম্পানি জমি নিয়ে ম্রো ও ত্রিপুরাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে, সেই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররাও ওই সময় (১৯৯৪-‘৯৫) জমি লিজ নিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে- কোম্পানির ৬৪ শেয়ারহোল্ডারের আলাদাভাবে লিজপ্রাপ্ত জমির মোট পরিমাণ ১ হাজার ৬০০ একর হলেও তাঁরা এর চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি দখলে নিয়েছেন এবং আরও জমি জোর করে দখল করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর ফলে সেখানে ইতোমধ্যে অনেক পাহাড়ি তাঁদের জমি হারিয়েছেন এবং আরও অনেকে হারানোর পথে।
লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- ৪০০ একর জমি দখলের জন্য ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জুমভূমি পুড়িয়ে দেওয়া; প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন; তাদের লাগানো বাগান ও গাছ কেটে দেওয়া; তাদের পানির উৎস ঝিরিতে বিষ ঢেলে দিয়ে গ্রামবাসীকে হত্যার চেষ্টা; ভূমি রক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা দেওয়া; ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার ওপর শারীরিক হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা; জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য এলাকাবাসীকে হুমকি; আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ৪০০ একর জমির বনজঙ্গল কেটে উজাড় করা ইত্যাদি।
গত ২৬ এপ্রিল ম্রো-ত্রিপুরাদের বিস্তৃত জুমভূমিতে আগুন দিয়ে ক্ষেত, বাগান ও পরিবেশ ধ্বংস করায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে সারাদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বান্দরবান জেলা পরিষদ ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। সরেজমিন তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, তারা লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে বান্দরবান জেলা পরিষদ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের কাছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লিজ বাতিলের সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার এই সুপারিশ আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা তার প্রমাণ। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কয়েকবার লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্রামবাসীর মধ্যে সালিশ বৈঠকের আয়োজন করেন। অপরাধী কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং গ্রামবাসীকে অধিকাংশ জমি কোম্পানির রাবার চাষের জন্য ছেড়ে দিতে চাপ দেওয়া হয়, যা তারা মেনে নেয়নি। বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে প্রায় ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পায় না- লামার এ ঘটনা তার একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।
এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিসাপেক্ষেও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজসহ অনেক লিজ গ্রহীতার লিজ বাতিল বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য। এই চুক্তির ‘ঘ’ অংশে বলা আছে- ‘রাবার চাষের ও অন্যান্য জমি বরাদ্দ :যে সকল অ-উপজাতীয় ও অ-স্থানীয় ব্যক্তিদের রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল, তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা গত ১০ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই, সেই সকল জমির বন্দোবস্ত বাতিল করা হইবে।’ ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা জুয়ামলিয়ান আমলাই ও সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা জানাচ্ছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রয়াত প্রমোদ মানকিন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতাকর্মী অবৈধভাবে ইজারা ভূমি প্রদান ও শর্ত লঙ্ঘনকারী ইজারা গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করলে পাঁচ শতাধিক ইজারা প্লট তাৎক্ষণিক চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনসহ সালামির টাকা প্রদান না করার কারণে বাতিলের আদেশ হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বাতিলকৃত অধিকাংশ প্লট বাতিলের এক মাসের মাথায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুনর্বহাল হয়ে যায়।’
ম্রো-ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর জনগণ এক সময় লামার বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাস করত। কিন্তু পাহাড়ে রাবার প্লান্টেশনের জন্য তাদের হাজার হাজার একর জুমচাষের জমি হাতছাড়া হয়ে যায়। তাদের ‘মরিবার মতো ঠাঁই’ ৪০০ একর জমিও এখন কেড়ে নেওয়ার জন্য আধুনিক জমিদাররা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
লামার ক্ষতিগ্রস্তসহ আমরা সবাই ন্যায়বিচার চাই। সন্দেহ নেই, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কর্তাব্যক্তিরা শক্তিশালী। কিন্তু তারা এত শক্তিশালী নয় যে, সরকার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে ভয় পেতে পারে।


থুইক্যসিং মারমা: সাংগঠনিক সম্পাদক, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটি

সূত্র: সমকাল 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *