ইলিরা দেওয়ান
জাতিসংঘ প্রতিবছর আদিবাসী দিবস সামনে রেখে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘লিভিং নো ওয়ান বিহাইন্ড: ইন্ডিজিনিয়াস পিপলস অ্যান্ড দ্য কল ফর আ নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, কাউকে পেছনে ফেলে রেখে নয়; আদিবাসী ও সামাজিক চুক্তির আহ্বান। আমরা সব সময় সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের বলতে শুনি, কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এর বাস্তবায়ন কি আমরা দেখি? সমতার কথা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় সমান অধিকারের কথা বলা হলেও এ দেশে যারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক অধিকারে সব সময় পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ আইএলওর ‘আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর কনভেনশন ১০৭ ’-এর অনুমোদন দিয়েছে, প্রায় অর্ধশতক বছর অতিবাহিত হয়েছে। অথচ এ দেশে যারা নিজেদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে ও এই পরিচয় ধারণ করতে চায়, তারা আজও পরিচিতির সংকটে নিমজ্জিত। তারা কী নামে পরিচিত হবে, সেটা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০ ’-এর মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তাদের ‘নৃগোষ্ঠী’ নামক অবমাননাকর শব্দে আবদ্ধ করার প্রক্রিয়া তখন থেকেই শুরু হয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও এ দেশে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা আছে, তাদের সংখ্যা কত, সেই গুরুত্বপূর্ণ সঠিক তথ্যগুলো সরকারের কাছে নেই! তাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস কিংবা বছরব্যাপী এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যে অঙ্গীকার শুনি, তাতে আমাদের দ্বন্দ্বেই পড়তে হয়
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও এ দেশে কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা আছে, তাদের সংখ্যা কত, সেই গুরুত্বপূর্ণ সঠিক তথ্যগুলো সরকারের কাছে নেই! তাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস কিংবা বছরব্যাপী এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যে অঙ্গীকার শুনি, তাতে আমাদের দ্বন্দ্বেই পড়তে হয়। যেখানে এই জনগোষ্ঠী আজও প্রতিনিয়ত চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সেখানে শান্তির প্রক্রিয়া দূরস্ত, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তার যেসব সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার রয়েছে, সেই অধিকারের জন্য আজও তাকে প্রতিনিয়ত যেখানে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, সেখানে এসডিজি পূরণের অঙ্গীকার আমাদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের দুই যুগ এবং আইএলওর ‘আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর কনভেনশন ১০৭ ’-এর অনুমোদনের চার যুগ পেরিয়ে গেলেও পাহাড় এবং সমতলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের বঞ্চনা ও বৈষম্যের চিত্র মোটেও পাল্টায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সেখানে বাক্স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা তলানিতে এসে ঠেকেছে।বিজ্ঞাপন
বর্তমানে সেখানে বৌদ্ধধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জবাবদিহি ও বিভিন্ন কার্যতালিকা জমা দিতে হয়। যেমন তাদের প্রতিষ্ঠানে কারা উপাসনা করতে আসে, সেসব উপাসনাকারী কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, ভিক্ষুর শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, মন্দিরের সম্পত্তির হিসাব, মন্দিরের স্থির চিত্র ক্যাপশনসহ, ভিক্ষুরা রাতে কোথায় অবস্থান করেন ইত্যাদি। সারা দেশে আর কোথাও কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ের এসব খুঁটিনাটি তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা দিতে হয় কি না, আমাদের জানা নেই। ২৪ বছরেও পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না করে সবকিছুকে নিরাপত্তার চশমার আওতায় এনে পাহাড়ের মানুষদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে শান্তির বাতাবরণের বুলি আওড়ানো যেন সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী।
স্বাধীনতার ৫০ বছর নিয়ে সরকার ও মূলধারার জনগণের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়। কিন্তু এই আড়ম্বরের উচ্ছ্বাস পাহাড়ে কতটুকু পৌঁছায়, সেই খবর রাখি কজন? বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোরা গত ৫০ বছরে দেশের রাজধানী ঢাকায় আসার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। তারা তাদের মতো সাধারণ জুমিয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। যদিও তারা বছরের পর বছর ধরে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। তবু সরকারের প্রতি তারা কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেনি। কিন্তু যখন তাদের বাপ-দাদাদের মাটি কেড়ে নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের মতো ভয়াবহ উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন তারা রাজধানীতে এসে স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে তাদের বাপ-দাদাদের মাটি রক্ষার আকুল আবেদন জানিয়ে গেছে। কিন্তু চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোদের সেই আকুতি কি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছেছে? আদিবাসী দিবসে চিম্বুকের ম্রো জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলে প্রতিনিয়ত জমি, ভিটেমাটি হারানো মানুষদের প্রতিবাদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করছি।
বিশ্বের সব প্রান্তেই আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা আজ বিপদাপন্ন। দেশের মূলধারার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করে থাকে, সেখানেও এই জনগোষ্ঠী অনুপস্থিত। আর বর্তমান করোনাকালে এসব প্রান্তিক মানুষেরা আরও চরম খাদ্য ও জীবিকা সংকটে পড়েছে।
এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্যে ‘সামাজিক চুক্তি’র ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এখানে চুক্তি অর্থে বোঝানো হয়েছে, এটি অদৃশ্য একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে আদিবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। অর্থাৎ প্রতিপাদ্যের মধ্যেই বিশ্বের তাবৎ আদিবাসীদের প্রকৃত অবস্থা নিহিত রয়েছে। বিশ্বের সব প্রান্তেই আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা আজ বিপদাপন্ন। দেশের মূলধারার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করে থাকে, সেখানেও এই জনগোষ্ঠী অনুপস্থিত। আর বর্তমান করোনাকালে এসব প্রান্তিক মানুষেরা আরও চরম খাদ্য ও জীবিকা সংকটে পড়েছে। এসব সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এ অদৃশ্য সামাজিক চুক্তির আহ্বান করা হয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বর্তমান সরকার প্রান্তিক ও মূলধারার বাইরের মানুষদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব গণমুখী উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে আমরা এটাও আশা করি, এসব সুফল যেন পাহাড় ও সমতলের সব জাতিগোষ্ঠীর কাছেও সমানভাবে পৌঁছায়। এ দেশের নিপীড়িত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষগুলোর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের ঘোষিত ‘সামাজিক চুক্তি’ যথাযথ বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ অর্থাৎ একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ই হোক আজকের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের মূল অঙ্গীকার।