নিজস্ব প্রতিবেদক।। “প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সুনিশ্চিত করে আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে” পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার উদ্যোগে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছে।
আজ শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯:০০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ গেইট প্রাঙ্গণে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক অনন্ত চাকমার সঞ্চালনায় এবং সভাপতি সুমন চাকমার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা, যুব সমিতি রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা (নান্টু), হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলার সহ-সভাপতি জিকো চাকমা, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সোনারিতা চাকমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা। মানববন্ধনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দেড়শত শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা বলেন, ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে যারা নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছেন তারাই আজ স্বাধীন দেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে চলেছেন। তাদের ভাষা সংরক্ষণ ও প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারছেনা। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী জাতিসমূহের মাতৃভাষা প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা লাভের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার কোনটির প্রতিফলিত হচ্ছেনা।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, উন্নয়ন ও শিক্ষা সংকটের একমাত্র সমাধার হল পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করে উল্টো অধিকার হরণ করা হচ্ছে। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থা জীর্ন-শীর্ণ। সরকার সেদিকে সুনজর না দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোন রকম আলোচনা না করে তড়িঘড়ি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থাকে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়নসহ সকল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা দাবি জানান।
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা তার বক্তব্যে বলেন, আমরা মাতৃভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। ভাষা একটি জাতির অস্তিত্বের পরিচয় বহন করে। একুশের চেতনা হলো সকল ভাষাকে সম্মান করা। কিন্তু যখন শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফেরা করি তখন বাঙালিরা আমাদের ভাষা নিয়ে নানাভাবে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, হেয় প্রতিপন্ন করে থাকে। তিনি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী ব্যবস্থা করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।
মানববন্ধনের সংহতি বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা (নান্টু) বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথ বাস্তবায়িত হয়নি। এই দুই যুগেরও অধিক সময় একটি জাতি কিংবা প্রজন্মের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু সরকার বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও আজ অবধি যথাযথ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তিনি আরো বলেন, আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় পার্বত্যঞ্চলের ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী মানুষগুলো তাদের ভাষা-সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবী জানান।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ সভাপতি জিকো চাকমা বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আজ বায়ান্নর সেই গৌরবময় সংগ্রামের ৭০ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও ফেব্রুয়ারি মাস আসলে এদেশের আদিবাসী তথা শিক্ষার্থীদের কড়া রোদে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের কাছে অনুনয় বিনুনয় করে অনুরোধ করতে হয়, দাবি জানাতে হয় যে, আমাদের মাতৃভাষায় অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার সুযোগ দিন। এটা যতটা না হতাশার, ততটা লজ্জার, তা বলার নয়। এদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এদেশের আদিবাসীদের ভাষাকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এবং সেই ভাষা চর্চা করার ক্ষেত্রটা তৈরী করে দিতে হবে।