কার্বনের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে

ইঁদুর ধরার ফাঁদ আছে, অন্যান্য পশু-পক্ষী ধরার ফাঁদও আছে- সবাই জানি। ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে’— রবীন্দ্রসংগীত আছে। তাহলে প্রেমের ফাঁদও আছে। কিন্তু আমাদের বিষয় ‘কার্বন ফাঁদ’, মানে কার্বন ধরার ফাঁদ, সেও আছে।

জীবন্ত কোষ (প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষ) অসংখ্য অণু দিয়ে গঠিত, যেগুলি ‘জৈব অণু’ নামে পরিচিত। এই ‘জৈব অণু’ সাধারণত ২৫টিরও বেশি উপাদান দিয়ে গঠিত, যার মধ্যে ৬ (ছয়)টি উপাদানকে জৈব অণুর কমন উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়; এগুলো হল কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস ও সালফার। জীবজগতের গঠনের দিক থেকে এই ছয়টি পরমাণুর মধ্যে কার্বন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু। এই কারণেই বলা হয় যে কার্বন হল পৃথিবীতে জীবনের ভিত্তি। কার্বন শুধুমাত্র কয়লা, পেট্রল বা জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বাস্তবে কার্বন জীবনের মৌলিক উপাদান এবং এটি প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ডিএনএ এবং অন্যান্য জৈব অণুর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বাংলা অভিধানে কার্বন শব্দের অর্থ অঙ্গার অর্থাৎ কয়লা জাতীয় পদার্থ। বস্তুত ইংরেজি কার্বন শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘কার্বো’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘কয়লা’। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এটি কাঠকয়লা এবং কাঁচের আকারে পরিচিত ছিল। কয়লা যে কালো, কারণ কার্বনের মৌলিক রং কালো। কালোকে যেমন জগতের আলো বলা হয়, তেমনি কয়লার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দ্যুতিময় পদার্থ- হিরা। শুনলে অবাক হতে হয় যে হিরা আসলে কার্বন।

১৭৭২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যান্টোয়ান ল্যাভোয়াসিয়ে প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে হিরা পোড়ালে (অক্সিজেনের উপস্থিতিতে) কেবলমাত্র কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়, অন্য কোনো পদার্থ নয়। তিনি অনুমান করেছিলেন যে হিরা মূলত কার্বনেরই একটি রূপ। ১৭৯৭ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ স্মিথসন টেন্যান্ট আরও নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেন যে হিরা ও সাধারণ কয়লা মূলত একই মৌলিক পদার্থ— কার্বন। অর্থাৎ, রাসায়নিকভাবে দুটোই বিশুদ্ধ কার্বন। হিরা কার্বনের একটি রূপভেদ । হিরার অনেক পৃষ্ঠ থাকায় যখন আলো হিরার ভেতর প্রবেশ করে, তখন এটি এক পৃষ্ঠ থেকে অন্য পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয় এবং প্রতিসৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় আলো ভেঙে যায় এবং বিভিন্ন দিকে বিচ্ছুরিত হয়, যা হিরাকে ঝকমক করে তোলে। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ও নরম পদার্থ দুটোই মূলত কার্বন, প্রথমটি হিরা, দ্বিতীয়টি গ্রাফাইট (পেনসিলের লিড এবং লুব্রিকেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত)।

হিরা ঝকমক করে- এটা কোনো খবর নয়। খবর, যা মহাউদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, তা হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বনের গ্যাসীয় রূপ কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা গত ৮০০,০০০ বছরের মধ্যে যে কোনো সময়ের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। এনওএএ/স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অব ওশেনোগ্রাফি জানাচ্ছে, এই সময়ের বেশির ভাগ সময় কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব প্রায় ১৫০-৩০০ পিপিএম-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে, ১৯৫০ সাল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪০০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২৪ সালে ৪২৪ পিপিএমেরও বেশিতে পৌঁছেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৪ সাল ছিল রেকর্ডের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস’ জানিয়েছে, ২০২৪ সাল ছিল প্রথম ক্যালেন্ডার বছর যখন গ্রহের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সালের শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ‘বিশ্ব আবহাওয়া দপ্তর’ জানিয়েছে, গত ১০ বছর রেকর্ডের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম ১০ বছর। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বা কীভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের গ্রহটিকে একটি বন্ধ সিস্টেম বলা হয়। এর মানে পৃথিবী কার্বন লাভ করে না বা হারায় না। কিন্তু কার্বন ক্রমাগত নড়াচড়া করে। যে প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ, প্রাণী এবং জীবাণুর মধ্যে কার্বন স্থানান্তরিত হয় তাকে ‘কার্বন চক্র’ বলে।কার্বন চক্র যেভাবে সংঘটিত হয়: উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং সূর্যালোক ব্যবহার করে জৈব পদার্থে (যেমন গ্লুকোজ) রূপান্তর করে। এই কার্বন ডাই অক্সাইডের বেশির ভাগই শিকড়, পারমাফ্রস্ট (আর্কটিক, সাইবেরিয়া, আলাস্কায় হিমায়িত), তৃণভূমি এবং বনভূমিতে সংরক্ষিত হয়। গাছপালা এবং মাটি ক্ষয় হলে বায়ুমণ্ডলে আবার কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। অন্যান্য জীবগুলিও কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয় যখন তারা বেঁচে থাকে তখন এবং যখন মারা যায় তখনও!

উদাহরণস্বরূপ, প্রাণীরা যখন শ্বাস নেয় তখন কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে এবং যখন তারা পচে যায় তখন কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। মহাসাগরগুলি কার্বন শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে কার্বন বিনিময় করে, যেখানে এটি দ্রবীভূত হয় এবং কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে। এটি বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, কিন্তু সমুদ্রের অম্লীকরণের দিকেও পরিচালিত করে। উপরন্তু, শিলা এবং অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক আমানতে কার্বন সংরক্ষিত হয়।উদাহরণস্বরূপ, কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি (যেমন তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস) উদ্ভিদ থেকে কার্বন দিয়ে তৈরি যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের নিচে লাখ লাখ বছর ধরে সংরক্ষিত আছে। যখন আমরা কাঠ, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং অন্যান্য ধরনের কার্বন পোড়াই তখন তা কার্বন চক্রের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ব্যাহত করে। সঞ্চিত কার্বন পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে আবার কার্বন অবমুক্ত হয়, যেখানে এটি একটি গ্রিনহাউস গ্যাসে পরিণত হয়।

কার্বন নিজেই দূষণের কারণ নয়। বরং কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনক্সাইড, মিথেন, কার্বোনিল সালফাইড, ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের মতো কার্বন যৌগগুলি, যখন অত্যধিক পরিমাণে নির্গত হয়, তখনই তারা জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কার্বন মনক্সাইড কার্বন-ভিত্তিক জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনের মাধ্যমে উৎপন্ন একটি বিষাক্ত গ্যাস। এটি মিথেন অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোক্সিল র‍্যাডিকেলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তাদের প্রাপ্যতা হ্রাস করে। ফলে, যদিও কার্বন মনক্সাইড নিজে একটি গ্রিনহাউস গ্যাস নয়, কিন্তু পরোক্ষভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান রাখে।

মিথেন জৈবিক এবং ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া দ্বারা উৎপাদিত একটি গ্রিনহাউস গ্যাস; বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান রাখে। কার্বোনিল সালফাইড আগ্নেয়গিরির গ্যাস এবং বায়ুমণ্ডলে পাওয়া যায়। এর গ্রিনহাউস প্রভাব নগণ্য; তবে এটি স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক সালফেট অ্যারোসলে অবদান রাখে, যা সূর্যালোক প্রতিফলিত করে গ্রহকে শীতল করতে পারে। সিএফসি গ্যাস বা তরল অবস্থায় থাকে। এটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, যা কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে তাপ ধরে রাখে। তাছাড়া সিএফসি বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বহিরাবরণের প্রায় ১৫-৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ওজোন স্তরের ক্ষতিসাধন করে থাকে। মানুষের কার্যকলাপ থেকে সিএফসি বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। রাসায়নিকভাবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *