খাগড়াছড়ি ।। ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’ এই শ্লোগানে এবং ‘আসুন, শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও গণশত্রুদের প্রতিহত করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বেগবান করি’ এই আহ্বানে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সম্মেলন ও ১৮তম কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গত ২৫-২৬ নভেম্বর ২০২১ টানা ২ দিন ব্যাপী এই সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
কাউন্সিলে নরেশ ত্রিপুরাকে সভাপতি, শান্ত চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও মিঠুন চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে।
২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের ১ম অধিবেশেনে সংগঠনের বার্ষিক সম্মেলনের নিয়ম অনুযায়ী জেলা শাখার নরেশ ত্রিপুরা, শান্ত চাকমা, টনক চাকমা যথাক্রমে সাংগঠনিক, অর্থ ও দপ্তর সম্পাদকের রিপোর্ট উপস্থিত প্রতিনিধি পর্যবেক্ষকদের সামনে পেশ করেন। পেশকৃত রিপোর্টের ওপর প্রতিনিধিবৃন্দ সংগঠনের গণতান্ত্রিকতা মেনে জবাবদিহিতা, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা ও সাংগঠনিক কাজের গতিশীলতা নিয়ে জোরালো মতামত তুলে ধরায় অধিবেশন প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। একে একে মতামত প্রদানের পর তুমুল করতালির মাধ্যমে প্রতিনিধিরা রিপোর্টসমূহ পাশ করেন।
জেলা কমিটি’র রিপোর্ট প্রদান সম্পন্ন হলে প্রতিনিধিবৃন্দ স্ব-স্ব শাখার সাংগঠনিক রিপোর্ট এবং সংগঠনের কার্যক্রম প্রসারিত করার লক্ষে সুচিন্তিত যুগপোযোগী প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
২৬ নভেম্বর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় পিসিপি’র দলীয় সঙ্গীত ‘পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রী দল’ গানটির মধ্য দিয়ে কাউন্সিলের ২য় দিনের ১ম অধিবেশন শুরু হয়। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড। সঙ্গীত পরিবেশনের সাথে সাথে পিসিপির দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জেলা সভাপতি সমর চাকমা, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ইউপিডিএফরে অন্যতম জেলা সংগঠক বিপুল চাকমা।
এরপর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী সকল শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ২ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
দ্বিতীয় দিনের ১ম অধিবেশেনে পিসিপি’র জেলা সাধারণ সম্পাদক নিকেল চাকমার সঞ্চালনায় ও সমর চাকমার সভাপতিত্বে মঞ্চে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রোটিক ফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক বিপুল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মার্মা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য রিমি চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুনিল ত্রিপুরা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যায় শাখার আহ্বায়ক মিটন চাকমা প্রমূখ। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নরেশ ত্রিপুরা।
এ সময় বক্তারা বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ছাত্র সমাজের কাছে একটি সংগ্রামী চেতনা, একটি আর্দশ, একটি প্রতিবাদের ঠিকানা। এই আদর্শিক সংগঠনের ওপর রয়েছে এক মহান গুরু দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজ অবধি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে বহু ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়েছে। বহু আত্মবলিদান দিতে হয়েছে।
তারা বলেন, শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় নির্যাতন, তল্লাশি, গ্রেফতার, মামলা-হামলা, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা, ভুমি বেদখল ছাত্র সমাজ কখনো মেনে নিতে পারে না। এই নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে ছাত্র সমাজের সাহসী অবস্থান জাতি দাবি করে। ছাত্র সমাজকে সংগ্রামী ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে শাসক যে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে তা নস্যাৎ করে দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান ন্যায়সঙ্গত প্রকৃত আন্দোলনকে ধ্বংস করে দিতে নিত্য নতুন পরি¯ি’িত তৈরি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের জাতি ধ্বংসের এই পলিসি প্রতিবাদ প্রতিরোধের হাতুরি দিয়ে ভাংতে হবে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই আন্দোলন সংগ্রাম বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার ইতিাহাস এটাই বলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজের সংগ্রামের ক্যানভাসে বহু গৌরবোজ্জ¦ল সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। লেঃ ফৌরদোস গং কর্তৃক অপহৃত কল্পনা চাকমাকে বাঁচাতে রুপন, সমর, মনতোষ, সুকেশের বীর সেনানিদের নাম এখন নক্ষত্রের ন্যায় ইতিহাসে জ¦লজ¦ল করছে। যে জাতির সন্তানরা বোনকে বাঁচাতে আত্মবলিদান দিতে পারে সে জাতির অধিকার একদিন আদায় হবে।
বক্তারা আরো বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন নিশি সরকারের হাতে কেউ নিরাপদ নয়। দেশের সমতলে জীবনের নিরাপত্তা ও গণপরিবহনে হাফ পাস নিশ্চিত করণের দাবিতে ছাত্র সমাজ আন্দোলন করছে, আমাদেরও এই দাবির সমর্থনে প্রতিবাদ করা উচিত। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটা ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু বাঙালিদের অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে শক্তিশালী আন্দোলন করা জরুরী।
দুই দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, সমর্থক, শুভাকাঙ্খীসহ ২০০ শতাধিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিলেন।
অধিবেশনের শেষান্তে জেলা সভাপতি সমর চাকমা নরেশ ত্রিপুরাকে সভাপতি, শান্ত চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও মিঠুন চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি প্রস্তাবনা আকারে উপস্থিত প্রতিনিধি পর্যবেক্ষকদের সামনে উত্থাপন করেন।
প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে প্রতিনিধিবৃন্দের কোন সংযোজন-বিয়োজন ও অভিযোগ না থাকায় তুমুল করতালির মাধ্যমে পাশ করে দিলে এই কমিটি চুড়ান্ত কমিটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কাউন্সিলে ২য় অধিবেশনে পুরাতন কমিটি বিলুপ্তি ও নতুন কমিটি ঘোষণা করে শপথ বাক্য পাঠ করান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরা। নতুন কমিটিকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় বিদায়ী কমিটি’র নেতৃবৃন্দ। নতুনদের আগমনে পুরাতনের বিদায়ের এক আবেগঘন মুর্হুতে শ্লোগানে শ্লোগানে হলরুম মুখরিত হয়।
কাউন্সিল অনুষ্ঠান আরো প্রাণবন্ত ও উজ্জীবিত করতে এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগাতে গানে-নৃত্যে যোগ দেয় প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড। ঘন্টা ব্যাপী প্রতিবাদী গান-নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে টানা ২ দিনব্যাপী সম্মেলন ও কাউন্সিল সম্পন্ন হয়।
এর পরপরই পার্বত্য কোটা বাতিল করে পাহাড়ি কোটা চালু ও গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে এবং নতুন কমিটি আগমন উপলক্ষে এক শুভেচ্ছা মিছিল করা হয়। এতে পিসিপি’র নবগঠিত জেলা সাধারণ সম্পাদক শান্ত চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, সভাপতি নরেশ ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী এন্টি চাকমা প্রমুখ।