লোগাং গণহত্যার ২৮ বছর : আজও হয়নি বর্বর এ গণহত্যার বিচার

লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের  বিক্ষোভ ১৯৯২।  ফাইল ছবি

আজ ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যার ২৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৯২ সালের এই দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-বিডিআর-এর প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সেটলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাঙে পাহাড়িদের গুচ্ছগ্রামে বর্বর গণহত্যা চালায়। শান্তিবাহিনী কর্তৃক এক বাঙালি রাখাল বালককে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে তারা এ গণহত্যা সংঘটিত করে। এতে কয়েকশত পাহাড়ি হতাহত হয়। অনেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেদিন শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পায়নি। অগ্নিসংযোগ করে ছাই করে দেওয়া হয় ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু) উৎসবের ২দিন আগে সংঘটিত এ গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাহাড়িরা। বর্জন করা হয় বৈ-সা-বি উৎসব।এই বর্বর গণহত্যার ফলে সে বছর বৈ-সা-বি’র আনন্দ উৎসব শোক সাগরে পরিণত হয়। ১৩ এপ্রিল’৯২ উৎসবের মূল দিন (মূল বিঝু) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক  সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকরাও আনন্দ উৎসবের পরিবর্তে আপামর জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়। খাগড়াছড়ির হাজার হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেদিন বাঁধ ভাঙা পানির মতো রাজপথে নেমে সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদ জানান। স্বতঃস্ফুর্তভাবে বৈ-সা-বি উৎসব বর্জন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে রান্না করা পাজন (মূল উৎসবের দিন হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি খাদ্য বিশেষ) চেঙ্গী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।

লোগাঙ পোড়া ভিটায় নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ। ফাইল ছবি

 বৈ-সা-বি উপলক্ষে ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকরা ১২ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যাবার পথে পানছড়ি উপজেলা সদরে সেনাবাহিনী তাদের বাধা প্রদান করে। ফলে তারা ঘটনাস্থলে যেতে পারেননি।
এরপর ঢাকায় ফিরে গিয়ে তারা সংবাদ মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তারা লোগাঙ হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। দাবিগুলো হচ্ছে-

(১) অবিলম্বে লোগাং হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এতদিন যত হত্যাকা-, ধর্ষণ, নিপীড়ন হয়েছে সেই ঘটনাবলীর বিচার বিভাগীয় তদন্তকার্য পরিচালনা করে সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।(২) পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ২০ বছরে সৃষ্ট পরিস্থিতি, রাজস্ব ব্যয় ও তার ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের জন্য বলপ্রয়োগের নীতি বর্জন করে বিষয়টিকে সংসদের অধীনস্থ করতে হবে এবং ঐ সংসদে খোলাখুলি আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।(৪) সংসদ সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্টি-দল ও সামাজিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে এবং ঐ অঞ্চলে সন্ত্রাসমুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করবার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।(৫) প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বেসামরিক নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন কার্যকর করতে হবে।(৬) অঞ্চলের সমগ্র জনগণকে হাতেগোণা কিছু লোকের শান্তিবাহিনীর সঙ্গে এক করে দেখার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ যাতে নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এ দেশের সব মৌলিক অধিকার ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লোগাং অভিমুখে পদযাত্রা, ২৮ এপ্রিল ১৯৯২। ফাইল ছবি

 এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘৯২ সালের ২৮ এপ্রিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় লোগাং অভিমুখে ঐতিহাসিক পদযাত্রা। হাজার হাজার নারী-পুরুষ এতে অংশ নেন। ঢাকা থেকে আসা রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী-লেখকরাও পাহাড়ি জনগণের সাথে সংহতি জানিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। সেনাবাহিনীর সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে সেদিন লোগাং পোড়াভিটায় গিয়ে তারা ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান জানান।
দীর্ঘ ২৮ বছরে দেশে ক্ষমতার নানা পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু কোন সরকারই বর্বর এ গণহত্যার বিচার করেনি। শুধু এই গণহত্যা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, কোনটিরই বিচার হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ চায় রাষ্ট্র লোগাং গণহত্যাসহ এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে সুষ্ঠু বিচার করুক। তাই রাষ্ট্রের উচিত এর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের ওপর অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটানো। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *