বান্দরবানে প্লান্টেশনের নামে জুমভূমি বেদখলের চিত্র

লামার সরই ইউনিয়নে ম্রো ও ত্রিপুরাদের জুমের জায়গায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সাইনবোর্ড। ফাইল ছবি

।। রিংসা ম্রো।। 

চাকমা রাজ কার্যালয় থেকে ২০২১ সালের জুনে প্রফেসর মংসানু চৌধুরীর সম্পাদনায় “পার্বত্য ভূমি সহায়িকা: পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার, ইজারা এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা” শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা এই লেখকের হাতে এসেছে। এই বইয়ে জুয়ামলিয়ান আমলাই ও বুদ্ধজ্যোতি চাকমার “বান্দরবান পার্বত্য জেলায় আদিবাসী পাহাড়িদের জমি বহিরাগত ও অনিবাসীদের কাছে ইজারা প্রদানে রাষ্ট্রের ভূমিকা” এবং রাজা দেবাশীষ রায়ের “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ১৯৯৭ এর বিধান ও অভিপ্রায় এবং পার্বত্য বান্দরবানে অবাসিন্দা কর্তৃক প্রাপ্ত বাণিজ্যিক ভূমি ইজারার প্রকৃত চিত্র” শিরোনামে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ লেখাও অন্তর্ভুক্ত আছে। লেখা দু’টিতে বান্দরবানে প্লান্টেশন বিশেষত রাবার প্লান্টেশনের নামে বহিরাগতদের দ্বারা পাহাড়িদের জুম ভূমি আত্মসাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বক্যমান নিবন্ধটি উক্ত দু’টি লেখা অবলম্বনে রচিত, বা বলা যায় উক্ত দু’টি প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত রূপ, যা মূলত নেট পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদনের জন্য লেখা হয়েছে।

বান্দরবানের সদর উপজেলাসহ লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলিকদম, এই চার উপজেলায় প্রশাসন পাহাড়িদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন জুমচাষের জমি বহিরাগতদের কাছে লিজ দিতে শুরু করে ১৯৮০ সালের ২৭ মার্চ থেকে এবং তা ২০০৭ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক বহু লিজ বাতিল অথবা বন্ধ থাকার কথা ছিল। মূলতঃ কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সির কৌশলের অংশ হিসেবে এই কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য – পাহাড়িদেরকে তাদের চিরাচরিত জুমভূমি থেকে উৎখাত করা এবং বহিরাগত সেটলারদের নিয়ে এসে জনমিতির ভারসাম্য রাঙালিদের পক্ষে নিয়ে আসা।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার বাগান করার জন্য উক্ত জমি লিজ দেয়া হলেও হর্টিকালচারের জন্যও কিছু লিজ দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে (স্মারক নং ১/বন – ১০৯/৭৫/৬২) ১৯৭৮ সালের ২৩ মার্চ রাবার স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার হলেন এই কমিটির সভাপতি এবং বনশিল্প গবেষণা কর্পোরেশনের (বিএফআইডিসি) মহাপরিচালক সদস্য সচিব। কথা ছিল ২০ হাজার একর জমিতে রাবার চাষ করা হবে। কিন্তু তার আড়াই গুণের বেশী পরিমাণ জমি লিজ দেওয়া হয়েছে এবং তাও নিয়ম বহির্ভূতভাবে, মৌজা হেডম্যানের প্রতিবেদন ও সরেজমিন তদন্ত ছাড়া। সর্বমোট ১,৪০৭টি রাবার বাগান ও ৪৬৪টি হর্টিকালচারের জন্য ১,৮৭১টি প্লটে ৪৬,৯৫২ একর জমি লিজ দেওয়া হয়েছে।

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র ভাড়াটে লোকজন ম্রো ও ত্রিপুরাদের জুমের জমি দখলে জোরপূর্বকভাবে জঙ্গল পরিষ্কার করছে। ফাইল ছবি

যারা জমির লিজ পেয়েছেন তারা হলেন মূলতঃ সমতল জেলার প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশী রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন। এই লুটপাটকারীদের দলে আছেন কর্নেল অলি আহমেদ, যিনি বিএনপি সরকারের আমলে যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন এবং জনসংহতি সমিতির সাথে সংলাপে সরকারী দলের নেতৃত্ব দেন; জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রধান আ. স. ম. আবদুর রব, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সাবেক জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন, চিত্রনায়ক সোহেল রানার মতো ব্যক্তিত্বও। এক সময় বান্দরবানে জমি ইজারা নেয়ার এমন হিড়িক পড়ে গিয়েছিল যে, তা, চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের ভাষায়, “প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং / অথবা সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে তাঁদের সহধর্মিণীদের নামে ভূমির ইজারা নেয়াটা ফ্যাশনের” মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি সমকাল পত্রিকায় ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর “৫৯৯ নারী ইজারাদার” শিরোনামে উন্মুল ওয়ারা সুইটি নামের এক সাংবাদিকের প্রতিবেদন উল্লেখ করেন, যা পড়ে লুটপাতের ভয়াবহতার চিত্র সহজেই বোঝা যাবে। ইকবাল নামে বান্দরবানের এক স্থানীয় বাঙালি উক্ত প্রতিবেদককে বলেন: “টিএনও, ডিসি ও সেনা অফিসারদের বউদের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে আমাদের এখানে অনেক কাহিনী আছে।” করিম নামে আরেক জন যোগ করে বলেন, “আপা, আমাদের এই ইউএনও স্যার ম্যারেজ ডে তে ভাবীরে খুশী করার জন্য একটা হর্টিকালচার প্লট ইজারা দিয়েছেন।”

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, লিজপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকে ২৫ একর জমি লিজ নিয়ে ২৫০ একর জমি নিজেদের বেদখলে নিয়েছে। অনেক সাধারণ পাহাড়ির বন্দোবস্তীকৃত জমিও লিজকৃত জমির সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডলুছড়ি মৌজায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ১,৬০০ একর ইজারাকৃত জমি রয়েছে। এ জমি ছিয়া পাড়ার বাসিন্দা ও ত্রিপুরা অধিবাসীদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। অথচ তারপরও যেন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের জমির ক্ষুধা মেটে না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা দুই বিঘা জমির জমিদারের মতো তারা আরও জমি চায়। কেড়ে নেয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উপেন’ দরিদ্র ম্রো, ত্রিপুরাসহ আদিবাসীদের অবশিষ্ট জমিও। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ছাড়াও একই এলাকায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনও দুই হাজার একরের বেশী পাহাড়িদের ভোগদখলীয় ও বন্দোবস্তীকৃত জমি নানা কৌশলে বেদখল করে নিয়েছে।

ইজারা প্রাপ্তদের মধ্যে মুসলিম হলেন ১,৩২৬ জন, হিন্দু ২১ জন, বড়ুয়া বৌদ্ধ ৬ জন, মারমা ১২ জন, চাক ১ জন ও খৃষ্টান ১ জন। (চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়) চার উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী জমি ইজারা দেয়া হয়েছে লামা উপজেলায়, এখানে রাবার ও হর্টিকালচার মিলে মোট প্লটের সংখ্যা ১০০৪, এবং জমির পরিমাণ ২৫,১০০ একর।

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজে কর্তৃক আগুন লাগিয়ে দিয়ে ম্রো ও ত্রিপুরাদের জুমের জমি ও বাগান-বাগিচা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফাইল ছবি

ইজারা হোল্ডিংয়ের সময়কাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৪-৮৫ এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালে সবচেয়ে বেশী ইজারা দেয়া হয়েছে। ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে মৌজা হেডম্যানের মতামত এবং মাঠ পর্যায়ে কানুনগো ও সহকারী কমিশনার (এ. সি. ল্যান্ড) কর্তৃক সরেজমিন তদন্তের মাধ্যমে দেয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্লট অনুমোদন ও ইজারা দলিল সম্পাদনের বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। ডেপুটি কমিশনারের দপ্তরে বসেই সমস্ত প্রতিবেদন তৈরি করে একদিনে শত শত প্লটের অনুমোদন ও ইজারা দলিল সম্পাদন করা হয়েছে।

সরকার এই ইজারা প্রাপ্ত ভূমিদস্যুদের সকল সুবিধা দেয়, অথচ তারপরও তাদের বেশীর ভাগ কোন রাবার বাগান বা হর্টিকালচার সৃজন করেনি। তারা ব্যাংক ঋণ এবং কাঠ ও পাথরের পারমিটের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। বিগত সাড়ে ৩ দশকে তারা কোন ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেনি, বরং ২০০৮ সালে সরকার তাদের কোটি কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করে দেয়।

রাবার ও হর্টিকালচারের বাগানে কাজ করার জন্য হাজার হাজার বহিরাগত বাঙালি শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছে। এতে পাহাড়িরা কেবল তাদের জুমভমি থেকে বঞ্চিত ও উচ্ছেদ হয়েছে তাই নয়, তাদের জীবন-জীবিকা এবং অর্থনৈতিক অবলম্বনও চরম হুমকির মুখে পড়েছে। কেউ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে বাগানিরা প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী মামলা দিয়ে হয়রানি ও গ্রেফতার করে। বিশেষ করে “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির” পরে ভূমিদস্যুরা আরও বেশী বেপরোয় হয়ে ওঠে এবং সেই সাথে পাহাড়িদের উচ্ছেদের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তারা পাড়াশুদ্ধ উচ্ছেদ হয়ে যায়। জেএসএস ও আঞ্চলিক পরিষদের নেতারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন সেটা জনগণ আশা করেছিল, কিন্তু তারা কোন আন্দোলন না করে বরং নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে তাদের সকল শক্তি নিয়োজিত রাখে। তারা ছিল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে ব্যস্ত, এসব নিয়ে আন্দোলন করার সময় তাদের ছিল না। আর ভূমিদস্যুরা এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নেয়।

রাজা দেবাশীষ রায় প্রশ্ন করেন, “এ বাসিন্দাদেরকে বঞ্চিত করে বান্দরবান অঞ্চলের এবং সমগ্র বাংলাদেশেরও বা কি কল্যাণ সাধিত হয়েছে? কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণাতে তো এই তথ্য আসেনি যে, রাবার, হর্টিকালচার বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে প্রদানকৃত ইজারার ফলে বান্দরবানবাসী ও এমনকি সারা দেশ তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হয়েছে। আর উপকারের হিসাবে কেবল ইজারাগ্রহীতা অ-বাসিন্দা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসমূহের আয়, লাভ বা মুনাফার ফিরিস্তি দিলে চলবে না। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত এবং প্রতিবেশগত যে ক্ষতি হয়েছে, তাও হিসেবে আনতে হবে। হিসেব করতে হবে এতে কারোর মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে কিনা।”

রাজার এই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। কিন্তু জনগণের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে কী করতে হবে? এর উত্তর হলো: জনগণকে সংগঠিত করা ও সংগ্রাম করা।

২১.০৬.২০২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *