ন্যায় বিচারের অপেক্ষা

সুনীল দেওয়ান

টেকনাফের মটকামুরা পাহাড়ের পাদদেশের বাড়িতে লাকিংমে চাকমার পরিবারের সদস্যরা-সমকাল

টেকনাফের মটকামুরা পাহাড়ের পাদদেশের বাড়িতে লাকিংমে চাকমার পরিবারের সদস্যরা

পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক হয়ে ৭১ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়ন। সেখানকার দক্ষিণ শিলখালী এলাকার চাকমাপল্লিতে যাওয়ার পুরো পথজুড়ে পাহাড় আর সমুদ্রের মিতালী। মূল সড়ক ছেড়ে মেঠোপথ ধরে এগোলে মটকামুরা নামের পাহাড়ের পাদদেশে আলোচিত সেই লাকিংমে চাকমার বাড়ি- যার মৃত্যু হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে; যে মৃত্যুর বিচার চাইছে এখন সারাদেশের মানুষ।

তখন পড়ন্ত বিকেল। সুপারি বাগানের ভেতর চোখে পড়ল একটি জরাজীর্ণ ছোট্ট টংঘর। সেখানেই লাকিংমের মা-বাবা ও ভাইবোনসহ সাতজনের বসত। তাদের চেহারা মলিন, চোখে-মুখে আতঙ্ক ও অসহায়ত্বের ছাপ। দুরন্ত পাহাড়ি মেয়ে লাকিংমেকে হারিয়েও স্বস্তি নেই তাদের। লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিচারের দাবিতে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি বাড়িতে গিয়েও পাওয়া যায়নি তাকে। লাকিংমের মা কোচিং চাকমা (৪০) সমকালকে বললেন, মামলার কাজে লাকিংমের বাবা কক্সবাজার গিয়েছেন। প্রায়ই এভাবে যেতে হচ্ছে আইনজীবী কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। পেট চালাতেই যেখানে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে এখন আতঙ্ক নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে বিচারের আশায়। তারপরও তিনি ন্যায়বিচারের আশায় আছেন।

পরিবারের অভিযোগ, গত বছরের ৫ জানুয়ারি টেকনাফের শিলখালি চাকমাপাড়া থেকে অপহৃত হয় লাকিংমে চাকমা। জন্মসনদ অনুযায়ী সেদিন তার বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। ৯ জানুয়ারি সকালে লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা টেকনাফ থানাকে লিখিত আকারে ও সুনির্দিষ্টভাবে জানান, তার মেয়েকে শাহপরীর দ্বীপের মাঝেরপাড়ায় কালা মনুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। পুলিশ সহযোগিতা না করায় তিনি নিজেই যান মেয়েকে খুঁজতে। কিন্তু ফিরে আসেন অপহরণকারীদের কাছে নিগৃহীত হয়ে। পুলিশ মামলা নিতে রাজি না হওয়ায় ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মেয়েকে উদ্ধারের জন্য মামলা করেন লালা অং চাকমা।

আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কক্সবাজারের পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। পিবিআই গত বছরের ৯ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, লাকিংমে চাকমা অপহরণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমার দেওয়া দুই পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের কোথাও এ কথারও উলেল্গখ নেই যে, হারিয়ে যাওয়া লাকিংমে চাকমা অপ্রাপ্তবয়স্ক। অপহরণের প্রায় এক বছর পর গত বছরের ৯ ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পায় তার পরিবার। এর পর লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা ও কথিত স্বামী আতাউলল্গাহর মধ্যে মরদেহ সৎকারের দাবিতে জটিলতা দেখা দেওয়ায় টানা ২৬ দিন লাশটি ওই হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকে।

পরে আদালত মামলাটি আবারও তদন্তের জন্য র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারকে দায়িত্ব দেন। র‌্যাবের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, লাকিংমে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এর পর আদালতের নির্দেশে মরদেহ বুঝে পান লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা। তবে নানা শঙ্কায় মেয়ের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাননি তিনি। গত ২৪ জানুয়ারি রামু উপজেলার জাদিমুড়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ মহাশ্মশানেই লাকিংমের শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়। মৃত্যুর ১৩ দিন আগে কিশোরী লাকিংমের একটি মেয়েশিশু জন্ম নেয়। আতাউলল্গাহর এক বোন মেয়েটিকে লালন-পালন করছেন।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি প্রতিনিধি দলের: লাকিংমে চাকমাকে অপহরণের পর কুমিল্লায় নিয়ে গিয়ে ভুয়া জন্মসনদ দিয়ে ধর্মান্তর ও বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছিল। অভিযুক্ত স্থানীয় যুবক আতাউলল্গাহ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে লাকিংমেকে এভাবে বিয়ে করে হত্যা কিংবা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যাচাই না করে ভুয়া জন্মসনদে লাকিংমের বিয়ে পড়ান কুমিলল্গা সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাজি নজরুল ইসলাম। গত ২৪ জানুয়ারি ওই কাজির সনদপত্র বাতিল ও তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে স্মারকলিপি দেয় কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে লাকিংমে চাকমার বাড়িতে যায় ঢাকা থেকে আসা মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোর ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।

এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আমিনুর রসুল, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপপরিচালক মুজিব মেহেদী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি সুলভ চাকমা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সাহিদা পারভিন প্রমুখ। প্রতিনিধি দল পরিবারকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি লাকিংমের ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ জোগানোর আশ্বাস দেয়। পরদিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা র‌্যাব, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠক করে লাকিংমের অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন।

মানবিক কারণে লাকিংমের বাবার করা মামলা বিনা খরচে পরিচালনা করছেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন খান। গত শনিবার সন্ধ্যায় তিনি সমকালকে বলেন, মামলাটি র‌্যাবের কাছে তদন্তাধীন আছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও আদালতের কাছে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময় চেয়েছে র‌্যাব। আমরা আদালতে নতুন করে বেশ কিছু পিটিশন দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনের পর ওইসব পিটিশনসহ পুরো মামলাটি আদালত আমলে নেবে। ওই দিনই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। তারপর আসামিদের গ্রেপ্তার করা যাবে।

এর আগে আসামিদের গ্রেপ্তারের কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, র‌্যাব প্রয়োজনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তিনি বলেন, র‌্যাব শুরু থেকে অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মামলা তদন্ত করছে। আশা করি লাকিংমের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে।

র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, নিহত কিশোরীর বয়স নির্ধারণসহ বিয়ের যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ হয়েছে। শিগগিরই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

একটি ঘর চায় লাকিংমের পরিবার: জরাজীর্ণ একটি ঘরে চলছে লাকিংমের পরিবারের বসবাস। একটু ঝড়েই উড়ে যাওয়ার দশা হয় ঘরটির। বর্ষা যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই তাদের মনে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর আশঙ্কা ভর করছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ড. মো. মামুনুর রশীদ গত শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি লাকিংমে চাকমার পরিবারকে একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে একটি প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছে। ওই দিন থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। ঘরের জন্য তার পরিবারের কিছু করতে হবে না- আমরা সরকারিভাবে ঘর নির্মাণ করে দেব। সংশ্নিষ্টদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *