‘৩০ অক্টোবর’ মুক্তিকামী জনগণের প্রেরণা লাভের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন

আজ ‘৩০ অক্টোবর’ মুক্তিকামী জনগণের প্রেরণা লাভের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন! ১৯৯৩ সালের এ দিন নারাঙহিয়া-খেজুড়বাগান এ এলাকায় ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে রচিত হয় এক বীরত্ব গাঁথা।

১৯৯৩ সালের ৩০ অক্টোবর পিসিপি জেলা কমিটি কর্তৃক আহূত শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘটে (ডিসি অফিসের সম্মুখে) মিছিল সহকারে যাত্রার প্রস্তুতিকালে খেজুড়বাগান মাঠে (বর্তমানে উপজেলা পরিষদ মাঠ) দাঙ্গা পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালায়। এতে পিসিপি’র তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত খীসাসহ ২০ জন ছাত্র ও ৩০ জন ছাত্রী আহত হন। এক জন ছাত্রের হাত ভেঙে যায়। সবচে’ বেশী জখম হয় ছাত্রীরা, তাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থও ছিল। এ ঘটনা বিদ্যুত বেগে খাগড়াছড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। এক কথায় পুরো জেলা পুলিশের বর্বরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে জ্বলে ওঠে। আক্রান্ত পিসিপি কর্মীরা দলবেঁধে ঘটনাস্থলে ফিরে আসে এবং অবরোধ সৃষ্টি করে। কান্তা-গুলতি মেরে ও বিয়্যং (কোমর তাঁতে ব্যবহৃত তলোয়ার সদৃশ কাল রঙের বিশেষ শক্ত কাঠ) দিয়ে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে পুলিশের হামলার জবাব দেয়। পুলিশ কার্যত খেজুড়বাগান উপজেলা সদরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ৩৮ টিয়ার শেল, ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে, আধা-সামরিক বাহিনী বিডিআর নামিয়েও প্রশাসন খাগড়াছড়ি-পানছড়ি রোড চালু করতে ব্যর্থ হয়। ছাত্র-জনতার পাল্টা জবাবে বেশ ক’জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়। কোমর তাঁতে ব্যবহৃত বিয়্যং ছিল পুলিশের জন্য আতঙ্কের বস্তু। সে সময় এমন গুজবও রটে যে, বিয়্যং-এর আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির জখম কখনই পুরোপুরি সেরে যায় না, রোগগ্রস্ত হয়ে আহত ব্যক্তি এক সময় মারা পড়ে! বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের হামলার জবাব দিতে প্রস্তুতি নেয়ার গুঞ্জনও চলে।

খেজুড়বাগানে হামলার প্রতিবাদে দীঘিনালা সদরে পিসিপি তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং পুলিশ তাদেরও লাঠিচার্জ করে মিছিল ভেঙে দেয়। আক্রান্ত পিসিপি কর্মীরা দলবদ্ধ হয়ে ফিরে এসে কান্তা-গুলতি মেরে পুলিশ সদস্যদের থানা পর্যন্ত তাড়িয়ে দেয়। দীঘিনালায় পুলিশ কার্যত ছাত্র-জনতার রোষের ভয়ে থানায় আটকে পড়ে। সেখানেও ছাত্র-জনতার পাল্টা জবাবে কয়েক জন পুলিশ সদস্য আহত হয়।

এদিকে খাগড়াছড়িতে আহত ছাত্রীদের দেখতে হাসপাতালে বলতে গেলে মানুষের ঢল নামে। স্থানীয় পানখিয়াপাড়া-মিলনপুরবাসী আহতদের খাবার সরবরাহ করে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার সংগ্রামী ঐক্য-সংহতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

প্রশাসনের দমন-পীড়নের পাল্টা হিসেবে গোটা খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্র-জনতার অবরোধের মুখে পড়ার উপক্রম হয়। প্রশাসন ঘটনার পরিণাম আঁচ করতে পেরে পিসিপি’র সাথে বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। ১ নভেম্বর ডিসি অফিসে আহূত বৈঠক পিসিপি বয়কট করে। ২ নভেম্বর সার্কিট হাউজে খাগড়াছড়ি জেলার উর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে পিসিপি’র বৈঠক হয়। বৈঠকের খাগড়াছড়ির এসপি খেজুড়বাগানে বিনা প্ররোচনায় হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং এডিশনাল এসপি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন।

প্রশাসন বিনা শর্তে আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তিদানের আশ্বাস দিলে, পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা অবরোধের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ২ নভেম্বর বৈঠক শেষে শুক্রবার ছুটির দিনে পিসিপি’র নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রশাসন মুক্তি দেয়। কারামুক্তদের নারাঙহিয়া চৌমোহনীতে রাতের মধ্যে ছাত্র-জনতা কর্তৃক সংবর্ধনা দেয়া হয়। সমাবেশস্থল থেকে সমবেত জনতা নারাঙহিয়া চৌমোহনীকে নাম দেয় ‘রেডস্কোয়ার’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *