ইনানীর চাকমাপল্লিতে হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভ

স্থানীয় প্রতিনিধি

জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত ইনানী চেংছড়ি আদিবাসী পল্লি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন-সমকাল

জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত ইনানী চেংছড়ি আদিবাসী পল্লি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ইনানী সৈকত থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে চেংছড়ি চাকমা পল্লি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদচারণায় ধন্য হয়েছিল অরণ্যঘেরা এই পল্লিটি। গ্রামের হেডম্যান ফেলোরাম রোয়াজার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এখানে গাছতলায় নীরবে-নিভৃতে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক।

দীর্ঘকাল অবহেলায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও জাতির পিতার স্মৃতিধন্য এই আদিবাসী পল্লি রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এখানে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভ। নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে রক্ষিত হয়েছে আদিবাসী পল্লির পাঁচ একর ভূমি। প্রশাসনের এই উদ্যোগের ফলে পাহাড়ি গ্রাম চেংছড়ি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

চেংছড়ি আদিবাসী পল্লিতে জাতির পিতার স্মৃতিরক্ষা কমিটির সদস্য সাংবাদিক তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উখিয়ার ইনানী সৈকতে এসেছিলেন। ওই মাসের ১৬ ও ১৭ তারিখ তিনি ইনানীতে বন বিভাগের রেস্ট হাউসে অবস্থান করেন। রেস্ট হাউসের পরিদর্শন বইতে বঙ্গবন্ধু নিজের নাম লিখে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই স্বাক্ষরটি এখনও রয়েছে। এই রেস্ট হাউসেই জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলীর অবস্থানের তথ্যও উল্লেখ রয়েছে।

কক্সবাজার শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ইনানীর আকর্ষণীয় পাথুরে সৈকতের কাছের কাঠের রেস্ট হাউসটি এখন আর নেই। সেখানে উঠেছে পাকা ভবন। তবে হারিয়ে যায়নি রেস্ট হাউসের পরিদর্শন বইটি। বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর দেওয়া পরিদর্শন বইয়ের সেই পাতাটি এখনও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যদিও পরিদর্শন বইয়ের পাতাটি কিছুটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ইনানীর রেস্ট হাউস লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বলে সংস্কার না করে উপায় ছিল না।’

ইনানী রেস্ট হাউসে অবস্থানকালীন বঙ্গবন্ধু যে ফেলোরাম চাকমার বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছিলেন, সেই মানুষটি আর বেঁচে নেই। রয়েছে তার উত্তরাধিকারীরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হাকিম জানান, ‘ফেলোরাম রোয়াজার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর জন্য অনেক রান্নাবান্না করা হয়েছিল। রান্নার ভার দেওয়া হয়েছিল সখিনা খাতুন নামে এক মহিলাকে। ইনানীর পাহাড়ি পরিবারগুলোর সঙ্গেই ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে ছিল সখিনার বাস। সেই সখিনা খাতুনও বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে স্থানীয় এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গুড়ের চা আর শাক ভাজি খেয়ে খুশি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।’

চেংছড়িতে জাতির পিতার সঙ্গী ছিলেন স্থানীয় আরেক আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল খালেক। তিনিও মারা গেছেন গত বছর। তার সন্তান বদিউল আলম জানান, ফেলোরাম রোয়াজার বাড়িতে যে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই গাছটিও আর নেই। তিনি যে পুকুরে অজু করেছিলেন সেটিও বেদখল হয়ে গেছে। চাকমা সমাজপতির যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু আতিথ্য নিয়েছিলেন খুঁটির ওপর কাঠের দোতলা সেই বাড়ি এখনও রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। জরাজীর্ণ এই বাড়ি যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে।

দেশ স্বাধীন হলে ফেলোরাম চাকমা একটি হরিণ শাবক নিয়ে বঙ্গবভনে গিয়েছিলেন বলে জানালেন তার নাতি রবি অং চাকমা। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি। পাহাড়ি সর্দার ফেলোরামকে পেয়েই বঙ্গবন্ধু বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন- এমনটাই তিনি বলতেন পরিবারের সদস্যদের। রবি অং চাকমা বলেন, ‘চেংছড়ি চাকমা পাড়ায় এখন আটটি পরিবার বসবাস করছে। এর আগে আরও কিছু আদিবাসী পরিবারের বসবাস এখানে ছিল। কিন্তু ভূমিদস্যুদের দাপটে পরাস্ত হয়ে তারা চলে গেছে অন্যত্র।’

২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর রবি অং চাকমা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই পল্লিটি ভূমিদস্যুদের কবল থেকে উদ্ধারের আবেদন করেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাবও রাখি। প্রশাসন আমাদের দাবি গ্রহণ করেছে।

স্থানীয় জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ‘দখলদারদের উচ্ছেদ করে পাঁচ একর জমি উদ্ধার করেছে প্রশাসন। এখানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। ফেলোরাম চাকমার সেই বাড়ি এখন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে এখানে দর্শনার্থীর আগমন শুরু হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চেংছড়ির খুব কাছে রয়েছে কানা রাজার গুহা। এই গুহাটিও হতে পারে পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ।’

কক্সবাজার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, জাতির পিতার স্মৃতিধন্য চেংছড়ি আদিবাসী পল্লি রক্ষায় ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় বরাদ্দে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে ১৬ ফুট উঁচু দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। দুই স্তম্ভের মধ্যখানে রয়েছে গোলাকার একটি এপিটাফ। পল্লির পাঁচ একর জমি সুরক্ষায় সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। এরপর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *