আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিবৃতি
———————————————————
৯ই আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আদিবাসী এবং আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার সকল অধিকারকামীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা, অভিনন্দন।
বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে যেসকল জাতিসমূহ বিভিন্ন পরিচয়ে যেমনঃ প্রথম জাতি, উপজাতি, আদিবাসী, ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি, ক্ষুদ্র-জাতিসত্ত্বা ইত্যাদি পরিচয়ে রয়েছেন তাঁদেরকেই মূলত আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বিশেষ কারণে আদিবাসী শব্দটির সুর্নিদিষ্ট সংজ্ঞা প্রণয়ন করা হয়নি তথাপি জাতিসংঘে দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে তাঁদের চিহ্নিত করণের লক্ষ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পেরেছেন। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আদিবাসী জাতিসমূহের আত্ম-পরিচয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিকার সংরক্ষণের জন্য আদিবাসী ও ট্রাইবেল জনগোষ্ঠি কনভেনশন-১৯৫৭(১০৭) ও পুনঃসংস্করণ আদিবাসী ও ট্রাইবেল জনগোষ্ঠি কনভেনশন-১৯৮৯(১৬৯) দুটি আইন গৃহীত হয়।
১৯৮২ সালের ৯ আগস্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সংস্থাটির ৪৯/২১৪ বিধিমালায় প্রথম বৈঠকের দিন অর্থাৎ ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই থেকে আর্ন্তজাতিক দিবসটি বিশ্বের ৯০টি দেশে ৪৭৬ মিলিয়ন আদিবাসীরা প্রতিবছর ৯ আগস্ট উদ্যাপন করে থাকেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৩ সালকে আদিবাসীবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চলের অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতির দাবীতে দিবসটি পালিত হয়।
প্রতি বছর ৯ আগস্ট আর্ন্তজাতিক দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হলেও বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে পালিত হয়ে আসছে। মূলত, ২০০১ সালের ১৩ই জুলাই বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠিত হবার পরে বেসরকারীভাবে বৃহৎকারে আর্ন্তজাতিক দিবসটি পালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এই দিবসটি পালনে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ বাণী এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের আদিবাসী জনগণের প্রাণের দাবির সাথে একত্মতা প্রকাশ করে আসলেও ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ করে আদিবাসী দিবস পালনের বিরোধীতাসহ “আদিবাসী” শব্দটি প্রয়োগেও সরকারী নির্দেশনার মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবির তোয়াক্কা না করে তাঁদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে জাতি হিসেবে বাঙালী এবং দেশে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসমূহকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ গোষ্ঠী, সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে তাঁদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে এবং যা আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত জনগোষ্ঠীগুলোকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে কন্ঠরোধ করার শামিল।
কোভিড -১৯ সংকট কিছু কিছু গোষ্ঠীকে অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে আঘাত করেছে। জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের একটি প্রতিবেদন এবং আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘আদিবাসীরা কোভিড-১৯ এর প্রত্যক্ষ (স্বাস্থ্য) এবং পরোক্ষ (অর্থনৈতিক, খাদ্য নিরাপত্তা) প্রভাবের জন্য বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, কোন কোন দেশে অ-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তুলনায় আদিবাসীদের মধ্যে উচ্চ সংক্রমণ এবং অধিক মৃত্যুর হার পরিলক্ষিত হয়েছে। আদিবাসী নারী ও মেয়ে এবং প্রতিবন্ধী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব আরও বেশি মারাত্মক।
সমগ্র বিশ্বের আদিবাসীরা বরাবরই রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতির কারণে অশান্তির মধ্যে রয়েছে এবং ঐতিহাসিকভাবে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন, সামরিকীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির নামে বেদখলের মাধ্যমে তাদের জমি এবং অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
এআইপিপি’র একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে- যেসকল জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে আদিবাসীরা বসবাস করছেন তাঁদের জীবনযাত্রার মানে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি, তারা এখনও প্রান্তীক অবস্থানে রয়েছেন। অধিকন্তু রাজনৈতিক সমস্যাসহ দ্বন্দ নিরসন না করে তাঁদের সংগঠনসমূহের রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সম্পাদিত রাজনৈতিক চুক্তিগুলোর বাস্তবায়নতো করা হচ্ছেই না উপরন্তু চুক্তির বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। অথচ চুক্তিগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং সম্মান করাই হচ্ছে অর্থপূর্ণ চুক্তি করার পূর্ব শর্ত এবং এটিই প্রাকৃতিক আইনের নীতি।
বিশ্বের আদিবাসী জনগণ এখন তীব্র অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। এর থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, আদিবাসী জনগণ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা নতুন সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে এবং রাজনীতি, সমাজ এবং অর্থনীতির পুনর্গঠন দরকার যার উদ্দেশ্য হবে অধিকতর ন্যায় এবং শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব, আন্তোনিও গুতেরেস “মহামারীতে অসমতা মোকাবেলায়: একটি নতুন যুগের জন্য নতুন সামাজিক চুক্তি” -তে সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্যঃ “Leaving No One Behind: Indigenous peoples and the call for a new social contract.” এর সাথে সংগতি রেখে “কাউকে পিছনে ফেলে নয়ঃ আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান” এর সাথে সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করছে, একইসাথে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরাসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার প্রদানের জোর দাবী জানাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।