সুধীর চাকমা
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বয়স আজ (২ ডিসেম্বর ২০২১) দুই যুগ পূর্ণ হলো। কিন্তু দুই যুগেও এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে ভবিষ্যতে এ চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে চুক্তি বাস্তবায়ন না হলেও চুক্তির বর্ষপূর্তি এলে দিনটি পালনে প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ শান্তির র্যালি করে, কেউ সভা করে, কেউ কনসার্টের আয়োজন করে। এখন তো ফানুসও উত্তোলন করা হয়, কেক কাটা হয়! চুক্তি বর্ষপূর্তিতে এসব তামাশা দেখলে মনে হয় যেন চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বড়ই শান্তি বিরাজ করছে! কিন্তু আদতে শান্তি তো নয়ই, উপরন্তু ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামের সেনাশাসনে পাহাড়ি জনগণ আজ চরমভাবে নিপীড়িত-নিষ্পেষিত।
এই চুক্তির সবচেয়ে ট্রাজেডির দিক হলো- চুক্তির পর পাহাড়িদের ওপর দুই ডজনের মতো সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখলসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যারা জড়িত, যারা চুক্তি লঙ্ঘন করে নতুন নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে, যারা পাহাড়িদের শান্তি হরণের জন্য দায়ি, সেই সেনাবাহিনীই শান্তির বুলি আওড়ায়, উৎসবমুখরভাবে চুক্তির বর্ষপূর্তি পালন করে, তথাকথিত শান্তি-সম্প্রীতির কনসার্ট আয়োজন করে থাকে। জনগণের সাথে এ এক নিষ্ঠুর রঙ্গ ছাড়া আর কী হতে পারে! আসলে এসব দেখে মনে হয়, সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে পার্বত্য চুক্তি হলো কেবল সেলিব্রেট করার বিষয়, বাস্তবায়নের বিষয় নয়। এই চুক্তি যেন তাদের কাছে দ্বিতীয় বিজয় দিবস।
আমরা চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এটাও প্রত্যক্ষ করছি যে, চুক্তি বর্ষপূর্তির দিনটি এলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের একটি পক্ষ (জনসংহতি সমিতি) হতাশার বাণী শোনায় আর অপর পক্ষ (সরকার) নানা আশ্বাসবাণী শুনিয়ে আর রঙ্গ-তামাশা করে দিনটি পালন করে থাকে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে একদিকে জনসংহতি সমিতির বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে, অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জমকালো নানা রঙ্গ-তামাশার আয়োজন করা হয়েছে।
দীর্ঘ দুই যুগেও চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে চাপে ফেলার মতো বড় কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারাটা জনসংহতি সমিতিরই ব্যর্থতা। এটা তাদের অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। যদিও ‘অসহযোগ আন্দোলন’ নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, তবে মাঝপথে সেটি কোথায় যে হারিয়ে গেছে তা কেউই জানতে পারেনি। ফলে সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করে যা ইচ্ছে তাই করেই যাচ্ছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, চুক্তির বর্ষপূর্তির দিনে সরকারের পক্ষ থেকে আনন্দ র্যালি হয়, উৎসব হয়, কনসার্ট হয়, সভা হয়, বাণী দেওয়া হয়, ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়, চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে আন্দোলনের তর্জন-গর্জন করা হয়, পুরোনো কর্মসূচিতে ফিরে যাবার হুমকিও দেয়া হয়। কিন্তু শেষ বেলায় চুক্তিও বাস্তবায়ন হয় না, আন্দোলনও হয় না। প্রতারিত হয় সাধারণ নিরীহ শান্তিকামী জনগণ।