আজ ৪ মে লংগদু গণহত্যার ৩১ বছর : আজও হয়নি বিচার

লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মৌন মিছিল, ২১ মে ১৯৮৯। ফাইল ছবি

আজ ৪ মে লংগদু গণহত্যার ৩১ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৮৯ সালের এই দিনে রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় আর্মি ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর(ভিডিপি) সহায়তায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পরিকল্পিতভাবে এ গণহত্যা চালায়। এতে বহু পাহাড়ি হতাহত হয়। সেটলাররা পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, বৌদ্ধ মন্দির ও বুদ্ধ মুর্তি ধ্বংস করে। কিন্তু আজও এই গণহত্যার বিচার হয়নি।

এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে বিকাল ৪-৫ টা নাগাদ লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ সরকার তার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার আড়াই ঘন্টা পর লংগদুতে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের উপর প্রতিশোধ মূলক হামলা শুরু হয়। এই প্রতিশোধমূলক হামলায় কম করে ৩৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশু মারা যায়। তবে এর প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে রিপোর্টে বলা হয়। আর আব্দুর রশিদ সরকারের মৃত্যুর জন্য শান্তিবাহিনীকে দায়ী করা হলেও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন কারণ খুঁজে পায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ্যামনেস্টির ওই রিপোর্টে বলা হয়, “… কম করে ৬টি গ্রাম আক্রমণ করা হয়, পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি, অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং খ্রিস্টানদের দু’টি গীর্জা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। যারা বেঁচে যায় তারা আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ে ও জঙ্গলে পালিয়ে যায় এবং তাদের একটা বিরাট অংশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।”
তৎসময়ে এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট পাহাড়ি নেতা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।
স্মারকলিপিতে তারা এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “উপজেলা সদরেসব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য, লংগদু ইউনিয়নপরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান  ও ৩নং লংগদু মৌজারহেডম্যান অনিল বিহারী চাকমা তার বাসভবনে হামলার শিকার হন। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচেগেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের অনেকে (যারা হেডম্যানের বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছিল) নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল্লম ইত্যাদি সহ আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারাগুলি করে এইসব নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃতদেহগুলিবাড়ীতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ী থেকে বের করে বাড়ীর পাশ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকে থানায় খবর দিতে এসে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন হদিস পাননি। পরিস্থিতিরএমন ভয়াবহতায় মৃতদেহগুলি ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সৎকার করা সম্ভব হয়নি”। (তথ্য সূত্র: রাডার, লোগাঙ গণহত্যা সংখ্যা)।
যে সময় এ ঘটনা সংঘটিত হয় সে সময় দেশে ছিল সামরিক শাসন। ক্ষমতার আসনে ছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদ। ফলে এ বর্বর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ সে সময় বাংলাদেশের কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি বা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। 
এই গণহত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জন্ম লাভ করে। 

লোমহর্ষক এ গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর জন্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৯৮৯ সালের ২১ শে মে ঢাকার রাজপথে মৌন মিছিল বের করে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ বর্বরতম এ হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ দাবি জানান। 
কিন্তু দীর্ঘ ৩১ বছরেও দেশের কোন সরকারই এ গণহত্যার বিচার ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার শাাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত সংঘটিত ডজনের অধিক গণহত্যারও কোন বিচার হয়নি। এমনকি এসব গণহত্যার সঠিক তদন্ত রিপোর্টও আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। 
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত এসব হত্যাযজ্ঞের বিচার না হওয়ায় বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হচ্ছে পাহাড়ি জনগণকে। পার্বত্য চুক্তির পরও এমন বর্বর হামলা থামেনি। বরং বলা যায় চুক্তির আগের চেয়েও বেশি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
গণহত্যার সাক্ষী সেই লংগদুতে ২০১৭ সালের ২ জুন পাহাড়িদের ওপর আবারো এক বর্বর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। এক বাঙালি মোটর সাইকেল চালকের লাশ উদ্ধারকে কেন্দ্র করে সেনা-প্রশাসনের সহযোগিতায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয় এবং ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে হত্যা করে।
সরকার তথা রাষ্ট্রের উচিত লংগদু গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদর ওপর এ যাবত সংঘটিত সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যথাযথ বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, যতদিন পর্যন্ত বিচার হবে না ততদিন পর্যন্ত জনগণ এসব হত্যাযজ্ঞের বিচারের দাবি জানাতেই থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *