বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে পিসিপি’র অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের ফলে পাহাড়িদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে

নিজস্ব প্রতিনিধি ।। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে গতকাল ১০ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর আয়োজিত অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জারি রাখার ফলে পাহাড়িদের ওপর প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করেছেন।

গতকাল বিকাল ৫ টায় আয়োজিত উক্ত অনলাইন আলোচনা সভায় পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সুনয়ন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সুনীল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান, ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর সংগঠক অংগ্য মারমা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায়। সভায় লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও সঙ্গত কারণে থাকতে পারেননি।

সভায় ব্যারিষ্টার সাদিয়া আরমান বলেন, থানায় মামলা না নেওয়া, গ্রেফতার, গুম-খুন করা সুষ্পষ্টত রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন। গুম আইনত গুরুতর অপরাধ। পাহাড়ে এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও এই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অনেক সনদে স্বাক্ষর করেছে যা সে অধিকারের বিষয়ে উল্লেখ আছে। কাজেই সে অধিকারগুলো রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে বাধ্য।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখে পাহাড়ি জনগণের উপর শাসন-নির্যাতন ও চলাফেরার অধিকার ব্যাপকভাবে হরণ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। সেখানে পাহাড়ি নিজ বাড়িতে, এলাকায় গেলে সেনা ক্যাম্পে কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, নিজ ঘর, বাড়ি, নাম, ঠিকানা ইত্যাদি বলে যেতে হয়। তিনি এসব নিপীড়ক ও বৈষম্যমূলক বিষয় আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পর থেকে পাহাড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি চলছে,এটি দেশের জন্য বড় একটি অর্জন। কিন্তু পাহাড়ে জনগণের বাক্ স্বাধীনতা, চলাফেরার অধিকার, মৌলিক অধিকার সর্বোপরি মানবাধিকার কতটুকু অর্জিত হয়েছে বা সরকার কতটুকু দিতে পেরেছে তার প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ানকে রাঙামাটি থেকে ঢাকায় আসার পথে সেনা চেকপোষ্টে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার তথ্য আলোচনায় তুলে ধরেন।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার হয় না। কল্পনা চাকমার অপহরণের বিচার ২৫ বছরেও হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে পাহাড়ে বার বার মানবাধিকার লংঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা পাহাড়ে বিচারহীনতার একটি প্রতীক, আমাদের কল্পনা অপহরণের ঘটনাসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকতে হবে, আন্দোলন করতে হবে।

ইলিরা দেওয়ান পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তুলে ধরে বলেন, রাষ্ট্র পাহাড়ের চলমান ন্যায্য আন্দোলনের বিষয়ে অপপ্রচার চালিয়ে জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্বকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের কাছে পাহাড়ি জনগণ রাষ্ট্রকে বিভক্ত করা বা বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে এমন বিপরীত মন্তব্য তুলে ধরছে। আমরা পাহাড়ি জনগণ, পাহাড়কে বাংলাদেশ হতে কখনো বিচ্ছিন্ন করতে চাইনি, হতে চাইনি, আমরা রাষ্ট্রের অখন্ডটা চেয়েছি। কিন্তু রাষ্ট্র পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতির অজুহাত দিয়ে ব্যাপক সামরিকায়ন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে, এখনো ঘটাচ্ছে। পাহাড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও দেশের পত্র পত্রিকায় তেমন প্রকাশিত হয় না।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমি আজকে এখানে কথা বলছি বা আমরা যারা পাহাড়ে নিপীড়িত জনগণের পক্ষে কথা বলি আমরা যে নিরাপদে থাকতে পারবো বলে আমি মনে করিনা। দেখা যাবে কয়েকদিন পরে আমি এসব কথা কেন বলেছি বা আমরা কেন এই কথা বললাম সে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তারপরও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে।

ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, রাষ্ট্র পাহাড়ি জনগণের অধিকারকে হরণ করতে পাহাড়ে সামরিকায়ন জারি রেখেছে এটি দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার। সামরিকায়নের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে সেটলার পুনর্বাসন করছে। যার মধ্যে দিয়ে সরকার পাহাড়ে জনমিতি পরিবর্তন করছে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান রিপোর্টে উল্লখ করা না হলেও বর্তমানে পাহাড়ে সেটলারদের সংখ্যা ৫১% ও পাহাড়িদের সংখ্যা ৪৯% এসে দাঁড়িয়েছে।

তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুরু করেছিল। ২০১৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে নান্যাচরে সেনাবাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা রমেল চাকমাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। তারপর সাজেক, দীঘিনালায় ইউপিডিএফ’র ৪ নেতা-কর্মীকে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। সেসব ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা স্পষ্ট হয়েছিল। এই কারণে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যৌক্তিকতার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছিল আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। ফলে রাষ্ট্র পাহাড়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করেছিল। ২০১৭ সালে নব্য মুখোশ (গণতান্ত্রিক) গঠন করে তাদেরকে দিয়ে ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমাসহ অনেক নেতা-কর্মীকে হত্যা ও খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে পিসিপি, যুব ফোরামের নেতাসহ ৭ জনকে হত্যা করিয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমাকে গুম করা হয়েছে। পাহাড়ে শুধুমাত্র এই বছরে ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীসহ ১৩৭ জনের মত বিনা কারণে গ্রেফতার করে অনেককে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পাহাড়ে সর্বপ্রথম ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমাকে আটক করা হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অংগ্য মারমা বলেন, কল্পনা অপহরণের ঘটনা ও গত বছর খাগড়াছড়ি জেলা সদরের বলপিয়ে আদামে এক প্রতিবন্ধী পাহাড়ি নারীকে গণধর্ষণের ঘটনাসহ অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার এখনো বিচার হয়নি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় দেখেছি পার্বত্য চুক্তির পর ৩৭টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে সরকার। কিন্তু ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ক্যাম্প নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অগণতান্ত্রিক ‘১১ দফা’ নির্দেশনা জারির মাধ্যমে পাহাড়ে জনগণের ন্যায্য অধিকার হরণ করা হয়েছে। সেখানে জনগণের মত প্রকাশের অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তির চলাফেরার অধিকার হরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ জনগণকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে।

তিনি সারা দেশে ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে এবং নিপীড়ন-নির্যাতনসহ রাষ্ট্রের সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক হরণ করা হচ্ছে। জনগণের মানবাধিকার রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক দমন করার কৌশল অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে, তাদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের এহেন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক দীলিপ রায় বলেন, পাহাড়-সমতলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো অনেকটা ভিন্ন। আলাদা আলাদাভাবে রাষ্ট্র নিপীড়ন চালায়। তিনি পাহাড়-সমতলে রাষ্ট্রীয় দ্বৈত শাসনের বিরুদ্ধে, নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান।

সভাপতির বক্তব্যে সুনয়ন চাকমা বলেন, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নানা সনদে স্বাক্ষরের পরও বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার মানুষের অধিকারকে ভূলন্ঠিত করছে। দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন, হয়রানি একটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের পাহাড় ও সমতলের প্রগতিশীল জনগণকে সচেতন এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *