পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব শুরু

ফাইল ছবি

প্রিতম বড়ুয়া অসি।। আজ ১২ এপ্রিল নদীতে ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু-চাংক্রান-বিষু-বিহু…)। তবে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই উৎসবকে ঘিরে চলছে তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহ ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসবকে পালন করে থাকে। তবে ত্রিপুরা ভাষায় ‘বৈসু’, মারমা ভাষায় ‘সাংগ্রাই’, ম্রোদের ভাষায় সাংক্রান/চাংক্রান, চাকমা ভাষায় ‘বিঝু’, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘বিষু’, অহমিয়া ভাষায় ‘বিহু’…এসব নামের আদ্যক্ষরের সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে উৎসবটি ‘বৈ-সা-বি’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। যা জাতিসত্তাগুলোর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবে অতীতের কিছু নিয়ম-কানুন বাতিল হয়ে গেলেও নতুনভাবে উৎসবের শুরুর দিন কিংবা তার আগে পরে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও জমায়েত সহকারে নদীতে ফুল দেওয়ার রীতি সংযোজন করা হয়েছে। এতে পাহাড়িরা সম্মিলিতভাবে স্ব স্ব জাতির পোশাক পরিধান করে, নিজেদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি তুলে ধরে র‌্যালিতে অংশ নিয়ে থাকেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে ও উৎসব উদযাপন কমিটি গঠন করে এ ধরনের র‌্যালি ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখন সরকারিভাবেও এ উপলক্ষে র‌্যালিসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বৈচিত্র্যময় এই উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলো নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধারণ করে সামাজিক মিলনের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধকে জাগ্রত করে। পুরাতন বছরের সকল গ্লানি মুছে গিয়ে সকল মানব জাতি ও প্রাণীকূল ‍নিরাপদে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকুক– এমন ভাবমানসই এই উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

এখানে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা সম্প্রদায়ের উৎসব নিয়ে সংক্ষিপ্তকারে তুলে ধরা হলো:

ত্রিপুরাদের বৈসু :  ত্রিপুরারা উৎসবের প্রথম দিনকে হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে  বৈসুমা বা বৈসুকমা, এবং তৃতীয় দিন অর্থাৎ নববর্ষ প্রথম দিনটিকে বিসিকাতাল বলে। হারি বৈসুর দিন নানান ধরণের ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে ঘরগুলোকে সুবাসিত করে তোলা হয়। ঘরের গৃহপালিত প্রাণি গরু-ছাগলকে ফুলের মালা পরানো হয়।

এরপর কিশোর কিশোরীরা দলবেঁধে ছড়া নদীতে গোসল করে ফুলি দিয়ে মঙ্গল কামনা করে বাড়িতে ফিরে মাইলোংমা (লক্ষ্মী) আসনে ফুল-ধূপবাতি দিয়ে পুজা সম্পন্ন করে থাকে। বিশেষ করে বাড়ির মায়েরাই ফুল দিয়ে গঙ্গা পুজা করে থাকে।

বৈসুমা দিনে ত্রিপুরারা তাদের বাড়িতে অতিথিদের বিভিন্ন সবজির মিশ্রণে রান্না করা পাচন, পিঠা সহ নানা খাদ্য-পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।

উৎসবের শেষ দিনে আগের দুইদিনের মতো অন্যান্য অনুষ্ঠান ছাড়াও এ দিনে বাড়ির মাতা-পিতা, দাদা-দাদীদের নদী থেকে জল তুলে এনে স্নান করানো হয়। নতুন কাপড় দান করা হয়। এদিন ত্রিপুরাদের প্রতিটি বাড়িতে পিঠা-পায়েস ছাড়াও মাছ-মাংসের আয়োজন চলে। বিশেষ করে এই দিনেই বড়োদের পানাহারের উৎসব চলে।

বৈসু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো তাঁদের প্রধান দেবতা গরিয়া দেবের খেরাবই নৃত্য। গরিয়া পূজায় যাঁরা নাচে তাঁদেরকে বলা হয় খেরাবই। গরিয়া দেবের প্রতিমূর্তিকে বহন করে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় নৃত্য পরিবেশন করে খেরবাই দল। দেখানো নয় ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার উপর খেলা ও অভিনয়।

মারমাদের সাংগ্রাই : মারমারা চারদিন সাংগ্রাই উৎসব পালন করে থাকে। সাংগ্রাইয়ের ১ম দিনকে পেইংছুয়ে (১৩ এপ্রিল), ২য় দিনকে আক্যেই (মুল সাংগ্রাই ১৪ এপ্রিল), ৩য় দিনকে আতাদা (১৫ এপ্রিল) ও ৪র্থ দিনকে আপ্যেইং (১৬ এপ্রিল) হিসেবে পালন করে।

সাংগ্রাইকে ঘিরে ঐতিহ্যবাহী পানি খেলার আয়োজন করা হয়। এই পানি খেলার মাধ্যমে তারা পুরানো বছররের গ্লানি মুছে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী ‘ধ’ খেলারও আয়োজন করা হয়ে থাকে।

উৎসবের প্রথম দিন পাড়ার যুবক যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। দল বেঁধে বুদ্ধ মূর্তি গুলোকে গোসল করানো হয়।

উৎসবের ২য় দিনে প্রত্যেকের বাড়িতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে পাচন, পানীয়সহ নানা খাদ্য পরিবেশন করা হয়।

সাংগ্রাই উৎসবকে ঘিরে মন্দির বা ক্যায়াং ঘর ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। দায়ক-দায়িকারা টানা তিনদিন অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় দীক্ষায় অভিভূত হয়ে বুদ্ধ মূর্তির সামনে ফুল রেখে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করে। পাড়ার লোকজন ক্যায়াং ঘরে গুরু ভিক্ষু, শ্রমণ, সাধু-সাধুমাদের উদ্দেশ্যে ছোয়াইং প্রদান করে। চন্দনের পানি, দুধ ও ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় এর নতুন বছর। এদিন তরুণ-তরুণীরা নতুন বছরকে বরণ করতে দলে দলে এসে পানি খেলায় মেতে উঠে।

চাকমাদের বিঝু :  চাকমারা ১ম দিনকে ফুল বিঝু (১২ এপ্রিল), ২য় দিনকে মুর বিঝু/মূল বিঝু (১৩ এপ্রিল) ও ৩য় দিনকে (১৪ এপ্রিল) গোজ্জেপোজ্জে বিঝু (নতুন বছরকে বরণ) হিসেবে পালন করে থাকে। 

উৎসবের প্রথম দিনে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে ফুল সংগ্রহে নেমে পড়ে। ঘরবাড়ি ও আঙ্গিনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। গৃহপালিত পশুদের (গরু, ছাগল) পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা। এরপর পাহাড়ি ছড়া, ঝর্ণা বা নদীতে গিয়ে গোসল করে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে মঙ্গল কামনা করা হয়। অনেকে পরবর্তী দিনে (মুর বিঝুর) ’পাজন’ রান্নার জন্য জঙ্গলে গিয়ে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত নানা সবজিজাত তরিতরকারি সংগ্রহ করে নিয়ে আসে (এখন অবশ্য সবকিছু বাজারে পাওয়া যায়)।

উৎসবের ২য় দিনে প্রত্যেকের বাড়িতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে কমপক্ষে ৩০ প্রকার বা তার বেশী আনাসপাতি দিয়ে রান্না করা ‘পাচন/পাজন’সহ নানা খাদ্য-পানীয় পরিবেশন করা হয়। নানা বয়সি লোকজন সারাদিন দল বেঁধে আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। উল্লেখ্য, এদিন ভোরে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরগীদের খাদ্য দেয়ার রীতি প্রচালিত থাকলেও বর্তমানে তা আর দেখা যায় না।

৩য় দিনে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়। এই দিন অনেকে পাড়ার বয়স্ক মুরব্বীদের বাড়িতে ডেকে ভাল কিছু খাবাবের আয়োজন করেন। আর অনেকে উৎসবের তিন দিনই মন্দির, বাড়ি আঙ্গিনা, নদীর ঘাট, বটবৃক্ষ বা সবুজ গাছের নীচে এবং গোয়াল ঘরে বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালান।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্তাগুলোও যার যার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও রীতি-নীতি অনুসারে উৎসবটি পালিন করে থাকে। এর মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যিবাহী ঘিলাখেলা প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে।

নোট: লেখাটিতে তথ্যগত ভুল থাকতে পারে। যদি সে ধরনের কোন ভুল নজরে আসে তাহলে আমাদেরকে জানিয়ে বাধিত করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *