বনের বাঘকে সবাই ভয় পায়। ভয়ে ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে চায় না। কারণ এ বনে সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রাণি হল এই বাঘ। এমনকি ভয়ে বাঘের নামের শেষে মামা জুড়ে দিয়ে সব পশুরা বাঘ মামা ডাকে। বাঘের এতে খুব ভালো লাগে। নিজের গুরু পরিচয়টা ফুটে ওঠে। বাঘকে দেখে সবাই ভয়ে পাল্য়া। অন্য যে কয়টা বাঘ এ বনে আছে তারা নিজ নিজ জীবন ও জীবিকা নিয়ে ব্যন্ত। ফলে বাঘ নিঃসঙ্গ। দিন যতই যাচ্ছে, বাঘ ততই যেন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে নেই ভেবে, বাঘ কখনো কখনো যেন নিজেকে অসহায় মনে করে। যদি না করুক অসুখ বিসুখ বাড়লে, সেবা করারও কেউ থাকবে না। তাই একদিন বাঘ মনস্থির করল তার একজন ভালো বন্ধুর খুবই প্রয়োজন। বন্ধুহারা জীবন চলে না। ভাবছে, কোথায় একজন ভালো বন্ধু পাবে।
ভাবতে ভাবতে মাথায় বুদ্ধি আসে। বুদ্ধি তাকে বন্ধু খুঁজে নিতে সাহায্য করবে। বুদ্ধির জোরে গভীর জঙ্গল থেকে বের হয়ে বন্ধু খুঁজতে নামে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ভালুøকের সাথে দেখা। বাঘ বলল, ভাল্লুক ভাইয়া,আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। একা একা আর ভালো লাগে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। তুমি আমার বন্ধু হলে, দুজনের সময় খুব ভালো কাটবে।
ভাল্লুক এই কথা শুনে বলল, না না বাঘ মামা। আমি তোমার বন্ধুত্বের আবদার রক্ষা করতে পারব না।
বাঘ বলল, কেন?
ভাল্লুক বলল, তুমি বনের হিংস্র প্রািণ। তোমার কোনো বিশ্বাস নেই। বন্ধুত্বের নাম দিয়ে যে কোনো সময় আমার প্রাণ নিতে পারো।
এই কথা শুনে, বাঘ খুব মর্মাহত হল।
ভাল্লুক যখন বন্ধুত্ব গ্রহণ করেনি, বাঘ পুনরায় বন্ধুর খোঁজে হাঁটতে শুরু করে।
যেতে যেতে দেখা হয় ছোট্ট এক খরগোশের সাথে। খরগোশ বাঘকে দেখে পালাতে যাবে, সেই মুহূর্তে, বাঘ বলল, ভয় পেয়ো না খরগোশ। আজ আমি তোমার কাছে একটি দাবি নিয়ে এসেছি। খরগোশ বলল কী দাবি?
বন্ধুত্বের দাবি। আমি খুব নিঃসঙ্গ। এখানে আমার কোন বন্ধু নেই। তুমি যদি আমার বন্ধু হও, আমার নিঃসঙ্গতা কেটে যাবে। দুজনের খুব ভালো সময় কাটবে।
খরগোশ কান দুটো খাড়া করে, বাঘের কথাগুলো শুনছিল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, না বাঘ মামা। আমার পক্ষে এই দাবি রাখা সম্ভব নয়।
বাঘ বলল, কেন সম্ভব নয়?
কারণ তুমি অনেক বড়। আমি খুব ছোট। বন্ধু হয় সমানে সমান। তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না। তোমার কোন বিশ্বাস নেই। আমার প্রাণ যেতে পারে।
একথা শুনে বাঘের খুব রাগ হল। বলল, একথা। খরগোশ লেজ উঁচু করে, দ্রুত বনের ভেতর ঢুকে গেল। বাঘ সামান্য টেরও পায়নি।
বাধ্য হয়ে বাঘ, আবার হাঁটতে শুরু করল। যেতে যেতে দূর পথে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভাবছে তার কপালে কোন বন্ধুত্ব নেই।
হঠাৎ চোখে পড়ে একটা বানর এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফালাফি করছে। বাঘকে আসতে দেখে বানর বলল, বাঘ মামা, এই বাঘ মামা! একা একা কোথায় যাচ্ছ?
বাঘ বলল, এসো তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।
নামতে নামতে বানর বলল, কী এমন জরুরি কথা?
বাঘ বলল, আমার সাথে তোমার বন্ধুত্ব হলে কেমন হয়?
বানর বলল, কেন বলতো বাঘ মামা? কেন আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছ? কোনো মতলব নেই তো!
বাঘ বলল, আরে মতলব টতলব না। একা একা আর ভালো লাগছে না। কতদিন আর একা থাকা যায় বলো।
বানর আফসোস করে বলে, আহা রে। সত্যিই তো একা থাকা অসম্ভব?
বাঘ বলল, তুমি আমার মনের কথা বুঝছ?
বানর বলল, কী?
বাঘ বলল, এই যে বন্ধুত্ব গ্রহণের কথা বলছ।
বানর বলল, কই না তো। আমি তোমার একাকিত্বের কথা ভাবছি। দয়া করে আমাকে মাফ করো। আমার পক্ষে কোনোমতে সম্ভব না, তোমার বন্ধুত্ব গ্রহণ করা। কারণ তোমার কোনো বিশ্বাস নেই।
বাঘ রেগে মেগে বলল একথা সবার। শুধু বিশ্বাসের কথা বলে। কেউ আমাকে বিশ্বাস করছে না। আজ আমি একা।
বানর তাড়াতাড়ি গাছের উঁচু ডালে ওঠে। বলল টা টা বাঘ মামা। ভালো থেকো।
আবার হাঁটতে শুরু করে বাঘ। মনের মধ্যে দেখা হয়, বনবিড়াল, নেকড়ে, বেজি, উদবিড়াল, সজারু, হনুমান, ইঁদুর, কাঁঠবিড়ালি, কুকুর কেউ বাঘের বন্ধুত্ব গ্রহণ করল না।
হাঁটতে হাঁটতে বাঘ একেবারে নদীর ধারে চলে এল। দেখা হয় এক শেয়ালের সাথে। বনের শেয়ালের মাথায় যত বুদ্ধি তা অন্য কোনো প্রািণর মধ্যে নেই, বাঘ এমন হেলে দুলে হাঁটছে দেখে, শেয়াল বলল, বাঘ মামা কোথায় যাচ্ছ?
বাঘ শেয়ালকে তার মনের কথা খুলে বলল। কেউ তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করছে না।
শেয়াল বলল, এই নদীতে একা একা কুমির থাকে। সে হয়তো তোমার বন্ধুত্ব গ্রহণ করতে পারে।
বাঘ শেয়ালকে ধন্যবাদ দিয়ে নদীর ধারে এসে দেখে, কুমির নদীর কিনারে আগে থেকে বসে আছে। বাঘ বলল, কুমির ভাইয়া, কুমির ভাইয়া আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই।
কুমির তো খুশিতে টগবগ করে উঠে। বলে, মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।
বাঘ বলল, কিছু বললে?
কুমির বলল, তা তো ভালো কথা। তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব।
বাঘ কুমিরের বন্ধুত্ব গ্রহণের খুশি হয়। বাঘ বলল, ঠিক আছে বন্ধু। এই কথায় থাকল। আজ থেকে আমরা বন্ধু।
কুমির মাথা নেড়ে সাড়া দেয়।
বিদায় নেয় বাঘ। পরদিন দেখা হবে বলে।
কুমির সারারাত ভাবে, বাঘকে কীভাবে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে নিজের আয়ত্তে রাখা যায়।
পরদিন বাঘ এসে হাজির।
কুমির বলল, কেমন আছো বন্ধু? তুমি আসবে আসবে ভেবে সারারাত আমি ঘুমাতে পারি নাই।
বাঘও বলল , আমিও বন্ধু ঘুমাতে পারি নাই।
কুমির বলল, তো আর কী খবর? রাজ্যের নানান কথা হয় বাঘ ও কুমিরের সাথে।
হঠাৎ বাঘের খেয়াল হয়। বাঘ সাঁতার জানে না। তার বাবা-মা তাকে কখনো সাঁতার শেখায়নি। সাঁতার না জানলে, পানিতে ডুবে মরার ভয় থাকে। বাঘ কুমিরকে বলল, সাঁতার শেখার কথা।
কুমির বলল, এটা কোনো ব্যাপার হল? আমি থাকতে তোমার সাঁতার শেখাটা সহজেই হবে। যেই কথা সেই কাজ।
শুরু হল বাঘের সাঁতার শেখা।
মাত্র কয়েকদিনে বাঘ সাঁতার শেখা শেষ করে। সে চাইলে এখন অতি সহজে নদীর এপার থেকে ওপারে সহজে সাঁতরে যেতে পারে। মনে মনে খুব খুশি বাঘ। কুমিরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায়। সাঁতার শিখতে পেরেছে বলে।
কুমিরও খুব খুশি। বাঘের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। মনে মনে ফন্দি আঁটে কীভাবে বাঘকে ঘায়েল করা যায়।
একদিন বাঘের খুব শখ হল, নদীর ওপারে যাবে।
কুমির বলল, ঠিক আছে।
দুজনেই যেতে যেতে যে মাঝ নদীতে আসল, ঠিক তখনই কুমির ঘাপটি মেরে হঠাৎ বাঘের একটা পা কামড়ে ধরে।
অনেক দিন ধরে বাঘকে বশে এনে খাওয়াটা ছিল কুমিরের উদ্দেশ্যে।
বাঘ মাঝ নদীতে ভয় পেয়ে যায়, কী করবে ভেবে পায় না। কুমির এমন কামড়ে ধরবে বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারে, অন্য প্রাণীদের মারলে ওদের কেমন লাগে। লেজ দিয়ে আঘাত করে কুমির। বাঘ ডুবে যাবে অবস্থা। যেহেতু সাঁতার জানে। তাই বিপদে মনোবল হারালে চলবে না। বাঘের মাথায় বুদ্ধি আসে। অন্য পা দিয়ে কুমিরকে আঘাত করে। কিন্তু কোনোমতে নিজেকে ছাড়াতে পাড়ে না কুমির থেকে। বাঘ তখন আবার একটা লাথি মারে কুমিরের মুখে। ব্যাথা পেয়ে কুমিরের মুখ থেকে পা‘টা ফসকে যায়।
বাঘ দ্রুত সাঁতরিয়ে কূলে উঠে আসে। কী বিপদ থেকে বাঘ বেঁচে গেল। পা থেকে রক্ত ঝরছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
পথের মধ্যে আবার শেয়ালের সাথে দেখা।
বাঘের এই অবস্থা দেখে শেয়াল বলল, কী হয়েছে বাঘ মামা?
বাঘ বলল, দুষ্টু শেয়াল। তোমার বুদ্ধি ধরে কুমিরের সাথে বন্ধুত্ব করে আজ আমার এই অবস্থা।
শেয়াল মুচকি হেসে বলল, তুমি যে অন্য প্রাণিদের মেরে খাও তখন কেমন লাগে?
বাঘ বলল, আর মরা গায়ে নুনের ছিটা দিও না।
খারাপ বন্ধুর চেয়ে একা থাকা ভালো। বলতে বলতে বাঘ বনের ভেতর চলে গেল।