আ-মরি বাংলা ভাষা

হাবিবুল হক বিপ্লব »

বছর ঘুরে আবার এলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাস বাংলা ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখন্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকেই সৃষ্টি হয় গণজোয়ার, শুরু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিবাদ এবং এরই উত্তাপে শেষ পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৫২ সালে এ ভূখন্ডের মানুষ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) তাদের মুখের ভাষা, মাতৃভাষা বাংলাকে আপন করে পাওয়ার জন্য যে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে, দুনিয়াজোড়া তার জুড়ি মেলা ভার। একুশ শতকের বৈশ্বিক-গ্রামে তাই ভাষা আন্দোলন তথা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মর্যাদা।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ঘোষণার পর থেকে জাতিসংঘসহ দেশে দেশে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে। কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস এটি। সেই আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ঘটে ১৯৫৪-এর গণরায়, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সংঘটিত হয় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এদেশবাসী পেয়েছে নিজস্ব মানচিত্র, নিজস্ব পতাকা। ফেব্রুয়ারি তাই বাংলাদেশিদের আত্ম-অনুসন্ধানের মাসও বটে। ফেব্রুয়ারির প্রতিটি সূর্যোদয় নবোদ্দীপক, দ্যোতনাময় ও নবজাগরণের হাতছানি দেয়। ১৯৫২ থেকে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক উত্থান-পতনের এই সময়ে পদ্মা- মেঘনার পানি অনেক গড়িয়েছে। তবুও জনজীবনে রফিক-সালাম-বরকতদের রক্তস্নাত মাসটির প্রভাব, আবেগ ও কৌতূহলে ভাটা পড়েনি। এতটুকু মলিন হয়নি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি জাতীয় চেতনাবোধ কতটা শাণিত ও জাগ্রত তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। জাতীয়তাবাদের এক প্রতিবাদী চেতনার স্ফূরণ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তাকে যেমন শাণিত করেছে, তেমনি রুখে দাঁড়াবার শক্তি দিয়েছে সব অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য, নির্যাতন, বঞ্চনা, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশিদের সমগ্র সত্তাকে ছুঁয়ে, আবেগ-অনুভূতিকে স্পর্শ করে এক প্রবল চেতনাদীপ্ত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত। বোদ্ধারা বলে থাকেন, পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক খাতগুলোতে উপর্যুপরি বৈষম্যমূলক বরাদ্দ, উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার আওতা থেকে পূর্ব বাংলাকে বাদ দেয়া, পূর্ব বাংলার সম্পদ ও সঞ্চয়ে পশ্চিম অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করা, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ পাচার, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার বেদনা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশাভুক্ত জনসাধারণের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ শাসনামলের পুঞ্জীভূত শোষণ-বঞ্চনা এ ক্ষোভের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবল প্রবণতা পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের পূর্বে অবিভক্ত ভারতের বাংলা ভাষার পক্ষে সাহিত্য সম্মেলন, পত্র-পত্রিকা থেকে মতামত গঠন পরবর্তীতে পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে আরও জোরদার করে। এ দাবির প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দম্ভোক্তি ও বিরোধিতার পাল্টা জবাব হিসেবে গড়ে ওঠে ‘তমদ্দুন মজলিস’, ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’-এর মতো সংগঠন-প্রতিষ্ঠান। এ সব প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ লালন করে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলা ভাষাবিরোধী পাক-শাসকগোষ্ঠীকে সমুচিত জবাব দেয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? বাংলা নাকি উর্দু?’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়। তমদ্দুন মজলিসের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন অধ্যাপক (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল) আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহ্বান করেন। সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
একই বছরের নভেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত ‘পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে’ পূর্ব পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবি জানান। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয় এবং ১৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণা দেয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষরসম্বলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে পেশ করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস দলীয় গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, বরকত, শফিকসহ নাম না জানা আরো অনেক শহীদের রক্তে স্নাত হয়ে যে ভাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হলো, রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলো তা বিশ্বের অন্যতম বিরল ঘটনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *