নিজস্ব প্রতিনিধি।। বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, রেংয়েন ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ায় বসবাসকারী ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুমভূমি জবরদখলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কোম্পানিটি এবার লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে সেটলার বাঙালিদের মাঠে নামিয়েছে।
গতকাল শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২) কথিত পার্বত্য নাগরিক পরিষদের নেতৃত্বে সেটলার বাঙালিরা সকাল থেকে দিনভর সরই ইউনিয়নে প্রবেশের বিভিন্ন পয়েন্টে লাঠিসোটা হাতে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। মূলত ‘সুলতানা কামালসহ একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল’ সরইয়ে আসার খবরে সেটলাররা এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ভুল বুঝিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে সেটলারদের জড়ো করে তাদের হাতে লাঠিসোটা দিয়ে সরই ইউনিয়নে প্রবেশ পথগুলোতে অবরোধ সৃষ্টি করে। তাদের তাৎক্ষণিক এমন কর্মকাণ্ডে এলাকার জনগণ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। কিন্তু সেটলাররা প্রকাশ্যে লাঠিসোটা হাতে পয়েন্টে পয়েন্টে মারমুখি অবস্থান নিলেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ সেটলারদের দিয়ে ম্রো ও ত্রিপুরাদের উক্ত ৪০০ একর জুমভূমি বেদখল করতে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করছে।
প্রসঙ্গত, লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড নামের রাবার কোম্পানি কর্তৃক বিগত ২০১৯ সাল থেকে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ম্রো ও ত্রিপুরাদের ভোগদখলীয় জুমভূমি জবরদখল করতে শুরু করে। ইতোমধ্যে তারা লিজ নেয়ার নামে সাড়ে তিন হাজার একরের বেশি ভূমি বেদখল করে নিয়েছে। যার কারণে অনেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। অবশিষ্ট তিন পাড়াবাসীর ৪০০ একর জুমভূমিও জবরদখল করতে কোম্পানিটি নানা চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। গত ৯ এপ্রিল ২০২২ কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা শ্রমিক নিয়ে এসে ম্রো ও ত্রিপুরাদের বাগান-বাগিচাসহ ভোগদখলীয় জমি কেটে সাফ করে দেয় এবং ২৬ এপ্রিল তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে পাড়াবাসীদের ফলজ, বনজ বাগান-বাগিচা, জুমখেত ও জুমভূমি পুড়ে গিয়ে পাড়াবাসীরা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন। তারা চরম খাদ্য সংকটে পড়েন। কিন্তু এ ঘটনায় জড়িত মূল হোতাদের কোন বিচার হয়নি।
এরপর ১৩ জুলাই ভূমিদস্যু রাবার কোম্পানির লেলিয়ে দেওয়া দুর্বৃত্তরা ভূমি রক্ষা আন্দোলনের নেতা রংধজন ত্রিপুরার ওপর হামলা চালায়। ১০ আগস্ট রেংয়েন ম্রো পাড়ায় নতুন স্থাপিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা, ভাংচুর ও দুটি বুদ্ধমূর্তি লুট করে নিয়ে যায়। ১ সেপ্টেম্বর ম্রোদের ক্ষেত থেকে ২৫ মণের অধিক মিষ্টি কুমড়া লুট ও ৬ সেপ্টেম্বর রেংয়েন ম্রো পাড়াবাসীদের পানির উৎস কলাইয়া ঝিরির পানিতে বিষ ঢেলে দিয়ে পানি বিষাক্ত করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় গত এক মাাসের মধ্যে ভূমি রক্ষা আন্দোলনে যুক্ত পাড়াবাসীদের নামে তিনটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
রাবার কোম্পানি কর্তৃক সংঘটিত এসব ঘটনার প্রতিবাদে এবং ৪০০ একর ভূমি রক্ষার্থে তিন পাড়াবাসী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করে মিছিল-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন।
কিন্তু ভূমিদস্যু রাবার কোম্পানি ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের ওপর অন্যায়-অবিচার জায়েজ করার জন্য এবং তাদের ৪০০ একর জুমভূমি জরবদখল করতে শেষ ভরসা হিসেবে সেটলার বাঙালিদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। আর সেটলার বাঙালিরা এখন ভূমিদস্যু রাবার কোম্পানির লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরইয়ে বসবাসকারী ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের নিরাপত্তা আরো বেশি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে, সেটলার বাঙালিদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে রাবার কোম্পানিটি ভূমি জবরদখল প্রচেষ্টা আরো জোরদার করতে পারে বলে তিন পাড়াবাসী গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।