লাকিংমে চাকমা’র হত্যাকান্ডঃ একটি অকাল মৃত্যু এবং বহু প্রশ্ন – অনুরাগ চাকমা

লাকিংমে চাকমা’র হত্যাকান্ডঃ একটি অকাল মৃত্যু এবং বহু প্রশ্ন – অনুরাগ চাকমা

 
লাকিংমে চাকমা’র হত্যার বিষয়টি নানা কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডি। কারণ, তার জন্ম একটি চাকমা পরিবারে, একটি দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে, একটি সুবিধাবঞ্চিত গ্রামে এবং এমন একটি রাষ্ট্রে যেখানে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করা একটি বিলাসীতা। আরও ইন্টারেস্টিং হল, নাবালক বয়সে অপহরণের শিকার, জোর করে ধর্ম পরিবর্তন, বিয়ে, সন্তানের জন্মদান এবং পরিশেষে পরিকল্পিতভাবে হত্যা। মৃত্যুর পরেও গ্রামে লাশ নিয়ে যাওয়াকে ঘিরে পরিবার এবং অন্যদের নিরাপত্তাহীনতা। লাকিংমে চাকমা’র জন্ম থেকে নৃশংস মৃত্যু যেন একটি সিনেমা! সাবাস বাংলাদেশ, সারা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়!

লাকিংমে চাকমাদের জন্য এই ধরনের মৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে একটি গবেষণার কাজে প্রায় এক সপ্তাহ কক্সবাজারে ছিলাম। সেসময় একজন স্থানীয় আদিবাসী নেতার ইন্টারভিউ করেছিলাম। তখন জানতে পারি কক্সবাজারের চাকমাদের ব্যাপারে। অবাক হয়েছি যখন শুনলাম, এসব চাকমারা নাকি যুগ যুগ ধরে কক্সবাজার জেলার পরিসংখ্যানে পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। আরও বিস্মিত হয়েছি যখন শুনলাম, তাদের নাকি অনেকের নামে বনবিভাগের মামলা দেওয়া আছে (জানি না কতটুকু সত্য!)। আরও শিহরিত হয়েছি যখন শুনলাম, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে জাতিগত নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন ২০১৭ সালের দিকে অসহায় হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, তখন নাকি উখিয়ার ভিতরে থাকা অনেক চাকমা উখিয়ার বাজারে পর্যন্ত আসতে পারেনি। কারণ, তাদের চেহেরা মায়ানমারের মানুষদের মত দেখতে এবং বাজারে গেলে রোহিঙ্গাদের আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয় ছিল। জানিনা, ২০২১ সালে তাদের এই অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? তবে হ্যাঁ, ইদানিং পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনে চোখ বুলালে কক্সবাজারের চাকমাদের ব্যাপারে একজন সচেতন মানুষের না বুঝার অবকাশ থাকে না। 

যাক এবার আসি একাডেমিক প্রসঙ্গে। লাকিংমে চাকমা এবং তার হত্যার বিষয়টি গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে অনেক variable পাওয়া যায় যেমন – লিঙ্গ (Gender), চাকমা(Ethnicity), দরিদ্রতা (Poverty) এবং দেশে আইনের শাসন (Rule of Law) ইত্যাদি। অর্থাৎ, একজন ভিকটিমের আর্থ-সামাজিক এবং ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য কতটুকু ন্যায় বিচার পাওয়ার বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে পারে? প্রশ্ন করে দেখুন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কতটা Gender-biased মুক্ত? দেশে একটি মামলা পরিচালনা করতে যে পরিমাণ অর্থের দরকার হয়, লাকিংমে চাকমা’র দরিদ্র পরিবার কি মামলা চালিয়ে যেতে পারবে? রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসিবে লাকিংমে চাকমার পরিবার কতটুকু ন্যায় বিচার পেতে পারে, যেখানে দুই দশকেও কল্পনা চাকমা’র অপহরণের বিচার হয়নি? এছাড়াও,রাষ্ট্রের Macro-level variables (যেমন – অপরাধ তদন্তে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা, এবং বিচার বিভাগের কার্যকর ভূমিকা ইত্যাদি) ভিকটিমের পরিবারকে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা (Size of the effects) রাখতে পারে? মোট কথা, একটি Representative sample নিয়ে গবেষণা করলে ন্যায় বিচার পাওয়ার সাথে Macro এবং Micro-level variables- এর Probabilistic relationship জানা যাবে। যেমন ধরুন, কি পরিমাণে রাষ্ট্রের অপরাধ তদন্ত করার সক্ষমতা বাড়লে সাধারণ জনগণের কত বেশি ন্যায় বিচার পেতে পারে?

Worldwide Governance Indicators-এর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আমি নিচের গ্রাফটি তৈরি করেছি এবং সবার সামনে উপস্থাপন করলাম। এখান থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন, ১৯৯৬-২০১৯ সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় Rule of Law সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কেবল মাত্র যুদ্ধদ্বিধস্ত আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের উপরে। বাকী পাঁচটি দেশ – ভুটান (সবার উপরে), শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ এবং নেপাল (বর্তমানে) – আমাদের দেশের উপরে অবস্থান করছে। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার কথা বাদই দিলাম। এই গ্রাফটি থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, একজন ভুটানীজ, একজন শ্রীলঙ্কান, একজন ভারতীয় এবং একজন মালদ্বীপের নাগরিক একজন বাংলাদেশী থেকে অনেক বেশি ন্যায় বিচার আশা করতে পারে। এবার বুঝতে পারছেন, কেন আপনি-আমি ন্যায় বিচার পায় না? আমরা বুঝতে না পারলেও অপরাধীরা ঠিকই জানে, তাদের শাস্তি হবে না।

পরিশেষে বলব, মানুষের যেমন তার বিভিন্ন অঙ্গ (যেমন – লিভার এবং কিডনি ইত্যাদি) কাজ না করলে তাকে মৃত বলা হয়, ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ (যেমন – আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ) যদি Fragile হয় তখন সেই রাষ্ট্রকে একটি Failed state বলা হয়। আমরা যেমন থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপি, তেমনি Empirical political scientist-রা বিভিন্ন Variable এবং Index দিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করে কিনা তা পরিমাপ করে থাকে। এরকম একটি থার্মোমিটার হল State Fragility Index। The Fund for Peace ১২টি Indicator দিয়ে ১-১২০ পয়েন্ট স্কেলে ১৭৮টি দেশের Fragility স্টাডি করে থাকে। যে দেশের Fragility score যত বেশি হবে সে দেশ তত বেশি Fragile। জানেন, বাংলাদেশের স্কোর কত? ১২০ পয়েন্টের মধ্যে ৮৫.৭০ পয়েন্ট! তার মানে আমাদের দেশ কি মৃত নাকি জীবিত? এসব আলোচনা করলাম একটি কারণে, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে গেলে এবং কল্পনা-লাকিংমে-তনু-অনেক নৃশংস মৃত্যুর পথযাত্রা বন্ধ করতে হলে, রাষ্ট্র চিন্তা নিয়ে গবেষণা করার বিকল্প নেই। মনে রাখবেন, সব অনাচার-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতনের মূলে আছে রাষ্ট্র। Barry Buzan তার People, States and Fear: An Agenda for International Security Studies in the Post-Cold War Era বইয়ে বলেছেন, রাষ্ট্র কেবল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। অনেক সময় জনগণের নিরাপত্তার হুমকিতে পরিণত হয়।

# লাকিংমে চাকমা’র পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং সুষ্ঠু বিচারের জন্য দাবি জানাচ্ছি

# বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সবায় এগিয়ে আসুন

# রাষ্ট্র চিন্তা নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে গবেষণা হোক

অনুরাগ চাকমা, সহকারী অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি গবেষক, Australian National University।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *