নিজস্ব প্রতিবেদক।। আজ ২৭ জুন ২০২২ রূপন, সমর, সুকেশ ও মনতোষ চাকমার শহীদ ও গুম হয়ে নিখোঁজ হওয়ার ২৬ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৯৬ সালের আজকের এই দিনে সেনা কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের দ্বারা অপহৃত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের দাবিতে বাঘাইছড়িতে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ পালন করতে গিয়ে তারা শহীদ ও গুমের শিকার হন।
কল্পনা চাকমা অপহৃত হন ১৯৯৬ সালের ১১ জুন দিবাগত রাত ১:০০-১:৩০টার মধ্যে (আন্তর্জাতিক সময়মান ১২ জুন) ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক ৭ ঘন্টা আগে। বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। তখন দেশের ক্ষমতা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আলোচিত এ অপহরণ ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্র মানুষ কল্পনা চাকমাকে অপহরণের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
এ অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী কল্পনা চাকমার পরিবারের সদস্যরা অপহরণকারীদের মধ্যে তৎকালীন কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে. ফেরদৌস ও ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক ও ভিডিপি সদস্য সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন।
উক্ত অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে এবং অপহৃত কল্পনা চাকমাকে দ্রুত উদ্ধার ও চিহ্নিত অপহরণকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন ২৭ জুন ’৯৬ তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয়। বাঘাইছড়িতেও সর্বাত্মক সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সেদিন অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে আরও অনেকের সাথে খেদারমারা গ্রামের সুকেশ চাকমা (১৬) ও সমর বিজয় চাকমা, বঙ্গলতলী গ্রামের মনতোষ চাকমা (২২) ও রূপন চাকমা (১৬) রাজপথে নেমে পড়েন।
এদিকে, অবরোধ কর্মসূচি বানচাল করে দিতে প্রশাসন ও সেটলার বাঙালিরা বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গোপন চক্রান্ত চালাতে থাকে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাতে জানা যায়, সেদিন সকাল থেকে যথারীতি অবরোধ কর্মসূচি শুরু করা হয়। অবরোধ চলাকালে এক পর্যায়ে সেটলাররা বিনা উস্কানিতে অবরোধ পালনকারী ছাত্র-জনতার উপর হামলা চালালে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে রূপন চাকমা সম্মুখ সারিতে থেকে হামলাকারীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে জনৈক সেটলার ভিডিপি সদস্য পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে অবরোধ পালনকারী ছাত্র-জনতার উপর গুলি ছোঁড়ে। এতে রূপন চাকমা ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
পরে পুলিশ ও সেটলাররা ফায়ার করতে করতে ছাত্র-জনতার দিকে এগিয়ে যায় এবং শহীদ রূপন চাকমার লাশটি তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। তারা রূপন চাকমার লাশটি আর ফেরত দেয়নি।
অপরদিকে, সমর বিজয়, মনতোষ ও সুকেশ চাকমা পিকেটিং-এ অংশগ্রহণের জন্য রূপকারী থেকে মারিশ্যা বাজারের দিকে যাওয়ার পথে মুসলিম ব্লক নামক স্থানে পৌঁছলে সেটলারদের আক্রমণের শিকার হন। সেটলাররা তাদেরকে ধাওয়া দিয়ে ধরে নিয়ে গুম করে ফেলে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কোন খোঁজ মিলেনি।
দীর্ঘ ২৬ বছরে কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার যেমনি হয়নি, একইভাবে রূপন, সমর, সুকেশ ও মনোতোষ চাকমাকে হত্যা-গুমের বিচারও আজও হয়নি। এ রাষ্ট্র বা সরকার হয়তো এ ঘটনাগুলোর বিচার কোনদিন করবে না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হওয়া পর্যন্ত লড়েই যাবে।
শাসকগোষ্ঠী কল্পনা, রূপন, সমর, সুকেশ, মনতোষদের অপহরণ, খুন, গুম করে পরিবার ও সমাজের বুক থেকে হারিয়ে দিলেও তারা অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও জনগণের মাঝে।