মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতা:

মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতা:
সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর উদ্যোগে ২০১৯ সালের শেষে মুসলিম সেটেলার, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সকল সংগঠনগুলোর বিলুপ্ত করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ নামে একক সংগঠন গঠন করে দেয়া হয় এবং এই সংগঠনের নেতৃত্বে সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী তৎপরতা, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা, নারীর উপর সহিংসতা, বহিরাগত মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ও বসতিস্থাপন, গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ইত্যাদি তৎপরতায় উস্কে দেয়া হচ্ছে। গঠিত হওয়ার পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাঙ্গামাটিতে এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বান্দরবানে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের সভা ঘেরাও করে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ঘোষিত লকডাউন ভেঙ্গে কক্সবাজার থেকে পালিয়ে এসে ২০২০ সালে রোহিঙ্গারা অবাধে বান্দরবান জেলায় অনুপ্রবেশ করেছে। কখনো নদী পথে, আবার কখনো পাহাড়ের ভিতর দিয়ে তারা অনুপ্রবেশ করেছে। যেমন জুন মাসে কিছু রোহিঙ্গা বান্দরবান পৌরসভার পাইংসি ঘোনাতে বসতি প্রদান করেছে। সেপ্টেম্বর মাসে রোহিঙ্গারা ব্যাপকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির সত্যতা পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় কিছু ক্ষমতাসীন স্বার্থান্বেষী মহল সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌলবাদী ও জুম্ম বিদ্বেষী কিছু ইসলামী গোষ্ঠী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে আদিবাসী জুম্মদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশেষত কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর পরই বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলিকদম উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীদের এ ধরনের ধর্মান্তরিতকরণের ব্যাপক কার্যক্রমের খবর পাওয়া গেছে। এই তৎপরতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মতি ও সহযোগিতা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক স্বীকার করা হয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গৃহ নির্মাণ, গরু-ছাগল পালন, সুদমুক্ত ঋণ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে বান্দরবান জেলায় ধর্মান্তরকরণ চলছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ছাঃলাওয়া পাড়ায় (শীলবান্ধা পাড়া) ৫ মারমা পরিবারের ২৭ জনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।
এমনকি লেখাপড়া শেখানোর লোভ দেখিয়ে আদিবাসী ছেলেমেয়েদেরকে তাদের মাতা-পিতা থেকে নিয়ে ঢাকা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পিতা-মাতার অজান্তে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা ২০২০ সালে সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে জুম্ম নারীদেরকে ফুসলিয়ে কিংবা ভালবাসার প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করা এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যার সর্বশেষ বলি হয়েছে উখিয়া উপজেলার ৭ম শ্রেণির ১৫ বছরের ছাত্রী লাকিংমে চাকমা। এই অপ্রাপ্ত কিশোরীকে জানুয়ারিতে অপরহণ করে নিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর করে বিয়ে করার পর ডিসেম্বরে খুন করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
উল্লেখ্য যে, বান্দরবান জেলায় ‘উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘ’, ‘উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ ও ‘উপজাতীয় আদর্শ সংঘ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি সংগঠনের নাম দিয়ে উপজাতীয় নুও মুসলিমজনবসতিও গড়ে তোলা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের মাধ্যমে জুম্মদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালানো হচ্ছে। বর্তমানে বান্দরবান পৌর এলাকার বাস ষ্টেশনে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ৩০ পরিবারের অধিক ত্রিপুরা ও খিয়াং এবং টাংকি পাড়ায় ১৫ পরিবারের নুও ত্রিপুরা মুসলিম, লামার লাইনঝিড়িতে ১৭ পরিবারের অধিক ত্রিপুরা মুসলিম ও গয়ালমারায় ৪৫টি পরিবার, আলিকদম-থানচি সড়কের ক্রাউডং (ডিম পাহাড়) এলাকায় ১৬ পরিবার ত্রিপুরা মুসলিম, আলিকদম-থানচি সড়কের ১১ কিলো এলাকায় আরো ৪৫ পরিবারের নুও মুসলিমের বসবাস রয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসে সেনাবাহিনীর দূর্ভেদ্য একুশ (২১ বীর)-এর লংগদু জোনের উদ্যোগে বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট ও মারিশ্যার চারকিলো নামক স্থানে নতুন করে কমপক্ষে ৫০০ পরিবার মুসলিম বাঙালি সেটেলার বসতি প্রদানের জঘন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বাত্যাপাড়া, ঝর্ণাটিলা, হেডম্যান টিলা, ভাইবোনছড়া, সোনাই, হাজাছড়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০০/২৫০ পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত প্রতি সেটেলার পরিবারকে ৩.০ একর পাহাড় ভূমি ও নগদ ১০,০০০ টাকা প্রদান করা হবে। অপরদিকে সেটেলার বাঙালিরা লংগদু উপজেলাধীন ডাকঘর মোন (বড় পাহাড়) থেকে বামে লংগদু পর্যন্ত প্রায় ৫০০ একর জায়গা তাদের নামে কবুলিয়ত আছে বলে দাবি করে জুম্মদের প্রথাগত ভূমি জবরদখলের পাঁয়তারা করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা, সর্বোপরি জুম্মকে দিয়ে জুম্মদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের জন্য সংস্কারপন্থী খ্যাত জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও এএলপি থেকে দলচ্যুত মগ পার্টি নামে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন দল আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২০ সালে ১০০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে, ৫০ জনকে অপহরণ করা হয়েছে, ১৭ জনকে মারধর ও হয়রানি করা হয়েছে, ৮ জনকে হত্যার হুমকি প্রদান হয়েছে, জনসংহতি সমিতির ৮২ জন সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া মগ পার্টি কর্তৃক ১২টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

২০২০ সালে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সদস্যদের রাঙ্গামাটি জেলার বরকলের সুবলং বাজার, লংগদু উপজেলার তিনটিলা, দীঘিনালার বাবুছড়া, কাপ্তাই ও রাজন্থলী উপজেলাসহ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সদর জেলার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্রভাবে মোতায়েন রেখে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির সদস্য ও চুক্তি সমর্থকদের উপর এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ টাকার চাঁদাবাজি করে চলেছে। সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীর ২১ বীর (দুর্ভেদ্য একুশ)-এর লংগদু সেনা জোনের পক্ষ থেকে সংস্কারপন্থী সশস্ত্র গুরুপে ২৫ সেট সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ডিসেম্বর মাসে সংস্কারপন্থীরা লংগদু থেকে জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের ২৮টি পরিবারকে উচ্ছেদের তৎপরতা চালায়।

২০২০ সালে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে সেনাবাহিনী যৌথভাবে বিভিন্ন জায়গায় টহল প্রদান ও তল্লাসী অভিযান চালাতেও দেখা গেছে। যেমন ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে রাজস্থলীতে সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ট ‘মগ পার্টি’ যৌথভাবে গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে চলছে। সেনাবাহিনীর এজেন্ডা মোতাবেক মগ পার্টি কর্তৃক জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের খুন ও অপহরণ করতে না পারার কারণে মগ পার্টির উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ডিসেম্বরে রাজস্থলী সেনা সাব-জোনের কম্যান্ডার মেজর মঞ্জুর ‘মগ পার্টি’কে আদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা লাশ চাই, আমাদেরকে লাশ দেখাও। তোমরা কোথা থেকে লাশ আনবে আমরা জানি না।’ এভাবে সেনাবাহিনী এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ ও প্রশ্রয় দিয়ে খুন-খারাবি, অপহরণ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
ছবি: প্রতিকি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *