মাটিরাঙ্গার তাইন্দংয়ে জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙ্গালিদের হামলার ৮ বছর

মাটিরাঙ্গার তাইন্দংয়ে জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙ্গালিদের হামলার ৮ বছর
পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তুপে নিঃস্ব সহায় সম্বলহীন এক পরিবার
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দংয়ে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ৮ বছর আজ।
২০১৩ সালের আজকের দিনে (০৩ আগস্ট) দুপুর আনুমানিক ১ ঘটিকার সময় সেটেলার বাঙালিরা প্রায় ৫ ঘন্টাব্যাপী জুম্মদের গ্রামে বর্বরোচিত হামলা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এতে ১১টি জুম্ম গ্রামের ৩৬টি বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। সর্বেশ্বর পাড়ায় একটি বৌদ্ধ বিহারসহ মোট ১৯টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, বগা পাড়ায় ১২টি, তালুকদার পাড়ায় ২টি ও বান্দরসিং পাড়ায় (ভগবান টিলা) ৩টি বাড়িসহ মোট ৩৬টি জুম্ম ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত করা হয়। সর্বেশ্বর পাড়ায় অবস্থিত জনশক্তি বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর চালিয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি্র হাত ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং বিহারে লুটপাট চালানো হয়। মনুদাস পাড়ার বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন জুম্ম গ্রামের প্রায় ৪০০ বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এ ঘটনায় বাধ্য হয়ে ৪৫৪ পরিবারের প্রায় ২০০০ জুম্ম গ্রামবাসী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় “নো ম্যান’স ল্যান্ডে” আশ্রয় গ্রহণ করে। ৩৮০ পরিবারের প্রায় ১,৫০০ ত্রিপুরা গ্রামবাসী পানছড়ি উপজেলায় ও ৩৫ পরিবার গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
সেটেলার বাঙালিদের হামলায় আহত হয় ১২ জন। পুলিশ ও বিজিবির সামনেই অনেককে সেটেলার বাঙালিরা জখম করে। বান্দরসিং পাড়া গ্র্র্রামের সুকুমণি চাকমার ২মাস বয়সী মেয়ে আশামণি চাকমা ৪ আগস্ট ২০১৩ ভারতের “নো ম্যান’স ল্যান্ডে” বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১০ আগস্ট খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে মারা যায়।
৩ আগস্ট ২০১৩ দুপুরের দিকে সেটেলার বাঙালিরা মো: কামাল হোসেন নামে জনৈক মটর সাইকেল চালক সেটেলার বাঙালি অপহৃত হয়েছে বলে প্রচার করে এবং তার দায় জুম্মদের উপর চাপিয়ে দেয়। ফলত তারপর থেকে সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। এ সমস্যার সমাধানকল্পে জুম্ম কার্বারী-মুরুব্বীদের বিজিবি ক্যাম্পে ডেকে নেয়া হয়। ওখানেই সমাধানের পরিবর্তে সেটেলার বাঙালিরা তাদের উপর হামলা চালায়। যেখানে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছিল।
৪ আগস্ট ২০১৩ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্তদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের আশ্বাসের ভিত্তিতে “নো ম্যান’স ল্যান্ডে” পালিয়ে যাওয়া জুম্মরা সেদিন বিকেল থেকে স্ব স্ব গ্রামে ফিরে আসেন। স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার ও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা কর্তৃক পূর্ণ নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মরা এখনো পর্যন্ত যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পায়নি।
৫ আগস্ট ২০১৩ বগাপাড়ার অধিবাসী অনিল বিকাশ চাকমা মাটিরাঙ্গা থানায় ৩০ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ১৭৫ জনের বিরুদ্ধে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মামলা দায়ের করেন। উক্ত হামলায় অনিল বিকাশ চাকমার বাড়ী সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয় সেটেলার বাঙালিরা। দায়ের করা মামলায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থক রয়েছে। এ মামলায় যাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে সেই মো: কামাল হোসেনসহ আবেদ আলী মেম্বার, আবু হানিফ মেম্বার ও কামরুজ্জানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ৮ আগস্ট ২০১৩ সন্ধ্যায় ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রামের বায়েজীদ থানাধীন টেক্সটাইল এলাকা থেকে এজাহারভুক্ত ১নম্বর আসামী তাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজী ও অপর আসামী তানাক্কাপাড়ার আবু হানিফ প্রকাশ ইধন সর্দারকে বায়েজীদ থানা পুলিশ আটক করে। তবে তাদের আটক করা হলেও পরে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের যোগসাজশে আটককৃতদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। এভাবে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতায় ধীরে ধীরে হামলার সাথে জড়িতদেরকে যথোপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে পরবর্তী আবারো সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটানোর উৎসাহ প্রদান করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *