নিজস্ব প্রতিনিধি।। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক সরই ইউনিয়নের ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুমভূমি জবরদখল বিষয়ে বান্দরবান জেলা প্রশাসনের আয়োজিত সভায় পক্ষপাতদুষ্ট ও একতরফা সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি।
জানা যায়, আজ মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট ২০২২) সকাল ১১টার সময় জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহারদূর উশৈসিং এর সভাপতিত্বে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র কর্তৃক সেখানকার বসবাসকারী ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুমভূমি জবরদখল নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা বিষয়ে এক শুনানি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজিও উপস্থিত ছিলেন।
উক্ত শুনানি সভায় রাবার কোম্পানি কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ও লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রংধজন ত্রিপুরার নেতৃত্বে ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক জয়চন্দ্র ত্রিপুরা (সাবেক কারবারি). রেংইয়েন কারবারি, সদস্য সচিব, লাঙকম ম্রো (কারবারি). সদস্য জোহান ম্রো, সদস্য বৈসুরাম ত্রিপুরাসহ ৩৫ জন এ শুনানি সভায় অংশগ্রহণ করেন। আর কথিত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র পক্ষে এতে অংশগ্রহন করেন ভূমি দস্যু মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ৫ জন।
সভায় জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রী বীর বাহাদূর একতরফাভাবে ভূমিদস্যু রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র পক্ষে রায় দেন বলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন এবং তারা জেলা প্রশাসনের এই একতরফা সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা বলেন, আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বাবু বীর বাহাদুর (উশৈসিং) সৃষ্ট সমস্যা সুষ্ঠুভাবে সমাধান করবেন। কিন্তু মন্ত্রী উল্টো ভূমিদস্যু ও কথিত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র পক্ষে অনৈতিক রায় দিয়েছেন। প্রতি পরিবারকে জুমভূমি ৫ একর করে বন্টন কখনো মেনে নিতে পারি না। ৪০০ একর জুমভূমি হচ্ছে আমাদের। এই জুমভূমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবো।
ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব, লাংকম ম্রো (কারবারি) বলেন, গত মে মাসে জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সরই ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে শুনানি হয়েছিল। সেই শুনানিতেও জেলা প্রশাসন সুষ্ঠু সমাধান না দিয়ে ভূমিদস্যুদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। আশা করেছিলাম মন্ত্রী মহোদয় সুষ্ঠু সমাধান দিবেন। কিন্তু মন্ত্রীও ভূমিদস্যু মোয়াজ্জেম হোসেন, কামাল উদ্দিন গংদের পক্ষে নৈতিক সমর্থন দিলেন। এই ধরনের অনৈতিক সমর্থন যুগিয়ে ৪০০ একর জুম ভূমি রক্ষা আন্দোলনকে কখনো দমিয়ে রাখা যাবে না। আমরা দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলব। আমাদের ৪০০একর জুমভূমি এক ইঞ্চি ও ছাড়বো না।
ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক রেংইয়েন কারবারি বলেন, গত ১০ আগষ্ট অশোক বৌদ্ধ বিহার হামলা, ভাংচুর ও বুদ্ধমূর্তি লুট করার কথা মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেছিলাম। মন্ত্রী চুপ থেকেছেন!! আর রংধজন ত্রিপুরার ওপর হামলাকারী মোয়াজ্জেম হোসেন, কামাল উদ্দিন গংদের বিচারও চেয়েছিলাম। মন্ত্রী মহোদয় টু শব্দ করেনি। উল্টো আমাদেরকে ধমক দিয়েছেন!
আরেক ভূমি রক্ষা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ফদরাম ত্রিপুরা বলেন, গত ৯ এপ্রিল ভূমিদস্যু মোয়াজ্জেম হোসেন, কামাল উদ্দিন গং ২০০ জনের অধিক রোহিঙ্গা ভাড়া করে জোরপূর্বক ত্রিপুরা ও জুম ভূমি দখলে নিয়ে ফলদ চারা, আম গাছ, কলা গাছ ও বাঁশ বাগান কেটে ফেলে এবং ২৬ এপ্রিল তা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এদের বিচার তো দুরের কথা, আজকের শুনানিতে উল্টো ধমক ও হুমকি খেয়েছি। জেলা প্রশাসন কর্তৃক এই অনৈতিক এক তরফা সিদ্ধান্ত ও শুনানি মানি না, মানবো না।
ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
তাদের দাবিগুলো হলো: ১। ৪০০ একর ভূমি কোম্পানিদের নয়, ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের। এ ভূমি বেদখল করা যাবে না; ২। বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও বুদ্ধমুর্তি লুটের বিচার করতে হবে; ৩। রংধজন ত্রিপুরার ও হামকারীদের বিচার ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; ৪। গত ৯ এপ্রিল রোহিঙ্গাদের নিয়ে এসে জুমভূমিতে ফলদ চারা, আম চারা, বাশঁ বাগান কর্তন ও ২৬ তারিখ জুমভূমি পুড়িয়ে দেয়ার জন্য বিচার, জড়িতদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; ৫। পাড়াবাসীদের ওপর দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং ৬। প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্টকারী সকল রাবার বাগানের ইজারা বাতিল করতে হবে।
ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য মথি ত্রিপুরা স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিগত ২০১৯ সাল থেকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর নামে লামা সরই ইউনিয়নের লাঙকম কার্বারি (ম্রো) পাড়া, রেংইয়েন কার্বারি (ম্রো) পাড়া ও জয়চন্দ্র কার্বারি (ত্রিপুরা) পাড়াবাসীদের ভোগদখলীয় ৪০০ একর জুমভূমি বেদখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এ বছর ৯ এপ্রিল পাড়াবাসীদের জুমভূমির জঙ্গল কেটে ফেলা হয় এবং ২৬ এপ্রিল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং গত ১০ আগস্ট রেংইয়েন কার্বারি পাড়ায় নতুন নির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর ও বুদ্ধমূর্তি লুট করে নেয় রাবার কোম্পানির লেলিয়ে দেয়া দুর্বৃত্তরা।
উক্ত জুমভূমি রক্ষার্থে তিন পাড়াবাসী লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির উদ্যোগে গত ১৪ আগস্ট এলাকাবাসী লামার সরই ইউনিয়নের লাঙকম পাড়ায় মানববন্ধন করে বৌদ্ধ বিহার ভাঙচুর, বুদ্ধমূর্তি লুট ও ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেন এবং জুমভূমি বেদখল বন্ধের দাবি জানান।