– পরঙ চাঙমা
১৯৬৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার শুরু হলে তার ঢেউ পার্বত্য চট্টগ্রামেও আছড়ে পড়ে। রাঙামাটিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠন করা হয়। এগার সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন আবুল কাসেম। এছাড়া কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন সুনীল কান্তি, দেব জ্যোতি চাকমা (দেবেন, যিনি জনসংহতি সমিতির অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত হন), গৌতম কুমার চাকমা (বর্তমানে আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য), অশোক মিত্র কার্বারীসহ আরও কয়েকজন।
কমিটির সদস্যরা সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী প্রচারণা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রীতি কুমার চাকমা ও অশোক মিত্র কার্বারী মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি, ভাইবোনছড়া ও পানছড়ি এলাকায় প্রচারণা চালানোর ভার নেন। অন্যদিকে দিঘীনালা এলাকায় প্রচার চালানের দায়িত্ব নেন দেবজ্যোতি ও গৌতম।
আন্দোলনের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল অকুণ্ঠ। তারা মহালছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলে সেদিন লঞ্চে তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হয়নি। কেন ভাড়া নেয়া হচ্ছে না জিজ্ঞেস করা হলে টিকেট প্রদায়ক জানান, ‘আপনারা দেশের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন, তাই লঞ্চের মালিক আগে থেকে আপনাদের কাছ থেকে ভাড়া না নিতে মানা করেছেন।’ তারা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন করছেন জানার পর মহালছড়ির চা দোকানেও তাদের কাছ থেকে সেদিন চায়ের বিল নেয়া হয়নি।
খাগড়াছড়ি বাজর, পানছড়ি, ভাইবোনছড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় আইয়ুব বিরোধী সমাবেশ হয়েছিল। খাগড়াছড়ি শহরে যেদিন সমাবেশ হয় সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, হাটবার। তাই সমাবেশে প্রচুর জনসমাগম হয়। এখানে অশোক মিত্র ও প্রীতি কুমার চাকমা বক্তব্য রাখেন। বাজারের দোকানদার ও উপস্থিত জনতা স্বতস্ফ‚র্তভাবে চাঁদা তুলে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের হাতে দিয়েছিলেন।
এরপর পানছড়িতে বাজার মাঠে বিকেল দু’টায় আইয়ুব বিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের ব্যাপারে লোকজনের আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। ছাত্রনেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য সময়ের বহু আগে অনেকে মাঠে জড়ো হয়। লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরেশ সেন চাকমা জনসভায় আন্দোলনের সমর্থনে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এখানেও জনতা ও দোকানের মালিকরা চাঁদা তুলে সংগ্রাম পরিষদের তহবিলে জমা দিয়েছিলেন।
ভাইবোনছড়ার সমাবেশেও ছিল একই চিত্র। আইয়ুব বিরোধী শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়। ‘সংগ্রামী ছাত্র পরিষদ জিন্দাবাদ, আইয়ুব খান গদি ছাড়ো।’ ‘আইয়ুব হটাও, দেশ বাঁচাও’।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনই প্রথম সারা দেশের সাথে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক আন্দোলনের মেলবন্ধন তৈরি করে। এটি ছিল পাহাড়ি-বাঙালির মিলিত প্রথম আন্দোলন। ইতিপূর্বে এখানকার জনগণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে পরিচিত ছিলেন না। বৃটিশ আমলে এক্সক্লুডেড এরিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। তাই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এখানকার জনগণের মনে এক বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে সারা পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হলে আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে।