পর্যটনের নামে জুমচাষের হাজার একর জমি দখল

অভিযোগ নাইক্ষ্যংছড়ির আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে

উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, বান্দরবানঅনলাইন ডেস্ক ।। নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়ি ইউনিয়ন এক সময় গভীর বন ও জঙ্গলে ঘেরা ছিল। বাস করত বন্য হিংস্র জন্তু। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেই সেখানে যুগ যুগ ধরে বাস করে আসছে আদিবাসী কয়েকশ’ পরিবার। বনের ভেতর জুম চাষ (পাহাড়ে বিশেষ কায়দায় চাষ) করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। সারাবছরের খাদ্য জোগান তাদের এখান থেকেই হতো। পর্যটনের নামে সেই জুমচাষের প্রায় এক হাজার একর জায়গা অবৈধ দখল হয়ে গেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে এ অবৈধ দখলের অভিযোগটি তুলেছেন আদিবাসীরা। এরই মধ্যে ১৫টি পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে প্রায় ৮ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিরি ভরাট করে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। অথচ জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পাহাড় কাটা ও পর্যটনের জন্য প্রশাসনের কোনো অনুমতিই নেননি ওই আওয়ামী লীগ নেতা। আদিবাসীদের ভয়ভীতি আর পর্যটন এলাকায় চাকরির লোভ দেখিয়ে এসব জায়গা দখল করা হচ্ছে। পাড়াপ্রধান ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জুম চাষ করতে না পারায় এ বছর অতি দরিদ্র অন্তত ৭০ পরিবার খাদ্য সমস্যায় পড়বে। কারণ এর বাইরে উপার্জনের অন্য কোনো উপায় নেই তাদের। পাশাপাশি ওই কয়েকশ’ পরিবারেরই জীবিকা হুমকিতে পড়বে।

জানা যায়, ২৭০ নম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি মৌজার প্রায় ১০০ একর, ২৭২ নম্বর জারুলিয়াছড়ি মৌজার প্রায় ৩৫০ একর, ২৬৯ নম্বর সোনাইছড়ি মৌজার প্রায় ৫৫০ একর মিলিয়ে প্রায় এক হাজার একর জায়গা পর্যটনের জন্য দখল নেওয়া হয়েছে। জায়গাগুলো জুমখোলা পাড়ার ৩০ পরিবার, ক্যকরোপ পাড়ার ৮০ পরিবার, ক্যং পাড়ার ১১০, লামার পাড়ার ৯০ ও সিংথোয়াই পাড়ার ৫০ পরিবারের দখলে ছিল। এরা সবাই চাক ও মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন। ক্যকরোপ পাড়াটি ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত। তবে কত সালে পাড়াটি স্থাপিত হয়েছে, নির্দিষ্ট করে কেউ জানাতে পারেননি। পাড়ার বাসিন্দারা জানান, যুগ যুগ ধরে বন্য জন্তুর সঙ্গে লড়াই করে জুম চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে পাড়াবাসীদের জায়গা আস্তে আস্তে দখলে নেওয়া হয়।
ক্যকরোপ পাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) লুহদ্মা মারমা বলেন, আমরা এখানে ব্রিটিশ আমল থেকে বাস করে আসছি। ওই সময়ে মানুষজন কম ছিল। চলাচলের রাস্তা ছিল না। চারদিকে ঘন বন-জঙ্গল। বিকাল হলেই শেয়াল, বনবিড়াল, মেছোবাঘের আওয়াজ শোনা যেত বাড়ির চারপাশে। আমার দাদু মংছড়িসহ আরো কয়েকজন মিলে ওই সময়ে এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। আস্তে আস্তে এখন পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। জুমের জায়গাও কমে গেছে।
সরজমিন দেখা যায়, সোনাইছড়ির ওই পর্যটনের স্থান থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। ড্রেজার দিয়ে দুই পাশের পাহাড় কেটে ঝিরিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। চলাচলের সুবিধার জন্য সেই বাঁধের আকার বড় করা হয়েছে। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য বড় বড় পাহাড় কেটে সমান করার কাজ চলছে।
পর্যটন এলাকার চারদিকে ঘুরে জানা যায়, গত বছর আরও কয়েকটি পাহাড় কেটে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে লতা, ছোট ছোট গাছ জন্মে ঢেকে গেছে সেই রাস্তা। পর্যটনের চারদিকে ঘুরতে সময় লেগেছে প্রায় চার ঘণ্টা। পর্যটকদের চলাচলের জন্য কাটা ১৫টি পাহাড়ের মধ্যে ৪টিই অনেক বড় আকারের ছিল। পাড়াবাসীদের তিলে তিলে গড়ে তোলা ফলদ বাগানও দখল হয়ে গেছে। কয়েকজনের রাবার বাগানও দখলে চলে গেছে। পরিত্যক্ত জুমের ঘর। কলাগাছগুলো আছে অযত্ন-অবহেলায়। পর্যটনের জায়গাতে রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণের জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে এই অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। এই অর্থের মধ্যে ঝিরিতে একটি ৪০ মিটার বাঁধ এবং টু-ভ্যান বক্স কালভার্ট নির্মাণ কাজ ধরা হয়েছে।
বাসিন্দারা জানান, জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে এলেও এসব জায়গা সরকারিভাবে তাদের নামে নেই। কারও কারও কাছে মৌজাপ্রধানের রিপোর্ট ছাড়া কোনো কাগজ নেই।
চাহদ্মাথোয়াই চাক বলেন, এখন আমাদের জায়গাতে আমরা প্রবেশ করতে পারছি না। বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মামলা দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।
ক্যসাইনু মারমা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমাদেরকে পর্যটন এলাকায় চাকরি দেওয়ার লোভ দেখানো হচ্ছে। আমাদের তো তেমন লেখাপড়া নেই। কী চাকরি করব! আমাদের চাকরির প্রয়োজন নেই। জমি ফেরত পেলে কোনোমতে বেঁচে থাকতে পারলেই হলো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক জোয়াম লিয়ান আমলাই বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনা চলমান। যেই লোক যেই পাহাড়ে প্রথম জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে, সেই জায়গাটি তার বলে ধরে নেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও অনেক জুম চাষি আছে, যাদের সরকারি খাতায় তৌজিভুক্ত জায়গার মালিকানা নেই। তবে তারা ওই জায়গায় যুগ যুগ ধরে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শফিউল্লাহ দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে দাবি করেন, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। একটি মহল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তিনি কাউকে ভয়ভীতি, লোভ দেখাননি। জোর করে কারও জায়গার দখল নেওয়া হয়নি। এগুলো সরকারের খাস জায়গা। পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, তাই দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো হচ্ছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) বাচিং চাক বলেন, চেয়ারম্যান মো. শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে এলাকার লোকজন জায়গা দখল বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। আমার ক্ষমতা না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারিনি। যেখানে পর্যটন করা হচ্ছে, সেখানে এলাকার মানুষের জায়গা পড়েছে, শুনেছি।
সোনাইছড়ি মৌজার হেডম্যান অংসিংথোয়াই মারমা বলেন, সরকারি খাতায় তৌজিভুক্ত না হলে ওই জায়গা খাস হিসেবে ধরা হয়। তবে ওই জায়গায় চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছে- এই ভিত্তিতে হেডম্যানের ক্ষমতাবলে জায়গার স্বত্ব বা মালিকানা বোঝাতে ওই মালিককে হেডম্যানের রিপোর্ট দেওয়া হয়ে থাকে।
পাহাড় কেটে পর্যটন করার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান জেলা শাখার সিনিয়র কেমিস্ট ছামিউল আলম কুরসি জানান, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের পর্যটন শিল্পের জন্য পাহাড় কাটার কোনো অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। যদি পর্যটনের নামে পাহাড় কাটা হয়; অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শফিউল আলম বলেন, চেয়ারম্যান মো. শফিউল্লাহ পর্যটন করার চেষ্টা করছেন, শুনেছি। তবে পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে ওই জায়গার ব্যাপারে এখনও কোনো চিঠিপত্র হাতে আসেনি। চেয়ারম্যান কারও জায়গা জোর করে দখলে নিলে সেটি তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তবে দখল বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র : সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *