১৯৯৬ থেকে ২০২০। দীর্ঘ দুই যুগ। এই সময়ের মধ্যে দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনেক পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হয়নি। উপরন্তু এ অপহরণ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে চিহ্নিত অপহরণকারীদের রক্ষায় নানা চক্রান্ত এখনো অব্যাহত রয়েছে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে সেনা কর্মকর্তা লে. ফেরদৌস, ভিডিপি কমাণ্ডার নুরুল হক ও পিসি সালেহ আহম্মদ’র নেতৃত্বে অপহৃত হয়েছিলেন কল্পনা চাকমা। এ ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয় এবং প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় তুলে। হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, প্রগতিশীল ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজ বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক এ ঘটনার বিচারের দাবি জানায়।
ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে ঘটনার প্রায় দেড় মাসের পর সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু ওই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন সরকারের নিকট জমা দিলেও তা আজো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
কল্পনা চাকমা অপহরণের সাক্ষী তাঁর দুই ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমা। তাঁরা অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনতে পেরেছিলেন। অপহরণ ঘটনার পর কালিন্দী কুমার চাকমা লে. ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে আসামি করে বাঘাইছড়ি থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে অভিযুক্তদের নাম বাদ দিয়ে মামলা রুজু করে।
মামলা করার প্রায় সাড়ে চৌদ্দ বছর পর ২১ মে ২০১০ তারিখে বাঘাইছড়ি থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই ফারুক প্রথম চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা এ প্রতিবেদনের ওপর নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ০২/০৯/২০১০ তারিখে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডি’র তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ দুইবছর তদন্ত করে চিহ্নিত অপহরণকারীদের নাম বাদ দিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সিআইডি’র তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর বাদী নারাজী দিলে বিজ্ঞ আদালত ১৬ জানুয়ারি ২০১৩ আরও অধিকতর তদন্তের জন্য রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৪ সালের ২০ জুলাই পুলিশ সুপার আমেনা বেগম তদন্ত অগ্রগতির প্রতিবেদন দাখিল করে বলেন যে “বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশ মতে লেঃ ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও ছালেহ আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দির আলোকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। ঘটনার ১৮ বছর পরে ভিকটিমের চেহারায় অনেক পরিবর্তন হতে পারে। তাই অদূর ভবিষ্যতে তাকে উদ্ধার করা হলেও চেহারা দেখে শনাক্ত করা নাও যেতে পারে। কল্পনার ভাইয়েরা বৃদ্ধ বিধায় ভিকটিমকে উদ্ধার করা হলে তাকে চিহ্নিত করার জন্য তার ভাইদের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য আদালতের নির্দেশপ্রাপ্ত হলেও মামলার বাদী ও তার ভাই লাল বিহারী চাকমা ডিএনএ সংরক্ষণের জন্য আগ্রহী নয় বিধায় তা সংগ্রহ করা হয়নি। যেহেতু এই মামলার মূল সাক্ষী ভিকটিম কল্পনা চাকমা নিজেই, তাই উক্ত কল্পনা চাকমা উদ্ধার না হওয়া কিংবা তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
বাদীর পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদন নাখোশ করা হলে ২৭ মে ২০১৫ রাঙামাটি জেলা জজ আদালতের বিচারিক হাকিম মোহসিনুল হক আবারো অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু মামলাটির তদন্ত সম্পন্ন না হয়ে আমেনা বেগম অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান।
তিনি ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি বলেন, “আমার তদন্তকালে ভিকটিমের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়ায় তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। এই লক্ষে বিশ্বস্ত গুপ্তচর নিয়োগ ছাড়াও বাদীর পক্ষে এবং এলাকার লোকজনদের সহায়তা কামনা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করিয়াও ভিক্টিম কল্পনা চাকমাকে উদ্ধার এবং মামলার রহস্য উদঘাটন হয় নাই। বিধায় মামলা তদন্ত দীর্ঘায়িত না করিয়া বাঘাইছড়ি থানার চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য নং ০৩, তারিখ ৭/৯/২০১৬, ধারা ৩৬৪ দ: বি: বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করিলাম। ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে”।
পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসানের দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে আবারো নারাজী আবেদন করেন। তার এই নারাজী আবেদনের উপর ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েক দফা শুনানী অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আদালত অপরাধীদের গ্রেফতারে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে শুনানীর নামে শুধু কালক্ষেপন করেই যাচ্ছে।
দীর্ঘ দুই যুগেও কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার না হওয়ায় দেশে বিচারহীনতার চিত্রই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। আর এতেই প্রমাণ হয়, এই অপহরণ ঘটনা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রীয় মদদদেই এই ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে।
এখন রাষ্ট্র বা সরকারের উচিত আর কালক্ষেপণ না করে আলোচিত এ অপহরণ ঘটনায় জড়িত চিহ্নিত অপরাধী লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় রাষ্ট্র এই ঘটনার দায় থেকে কখনো মুক্ত হতে পারবে না।
এদিকে দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছর নানা প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হলেও এ বছর করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বড় ধরনের কোন কর্মসূচির কথা জানা যায়নি। তবে অনলাইনে প্রতিবাদমূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে বলে হিল উইমেন্স ফেডারেশন জানিয়েছে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা গতকাল রাতে তাঁর ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, কল্পনা অপহরণের বিচার ও আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে নানা অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়েছে এবং এখনো অব্যাহত আছে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও দীর্ঘ দুই যুগ ধরে কল্পনা ইস্যুটি জ্বলন্ত হয়ে আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
ফেসবুকে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসে তিনি কল্পনা চাকমা অপহরণের সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীদের সাজা না হওয়া পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।