নিজস্ব প্রতিবেদক।। একুশে পদকে ভূষিত হচ্ছেন পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম ও মোনঘর শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরো। সমাজসেবায় অবদান রাখায় তাঁকে এ পদকে ভূষিত করা হচ্ছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিককে ২০২২ সালের একুশে পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে ৫ জনকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে সংঘরাজ শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের অন্যতম। বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায় যে, ২০২২ সালে একুশে পদকের জন্য মনোনীতরা হলেন- ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য মোস্তফা এম এ মতিন (মরণোত্তর), মির্জা তোফ্ফাজেল হোসেন (মরণোত্তর)। শিল্পকলায় (নৃত্য) জিনাত বরকতউল্লাহ, নজরুল ইসলাম বাবু (মরণোত্তর) শিল্পকলা (সংগীত), ইকবাল আহমেদ শিল্পকলা (সংগীত), মাহমুদুর রহমান বেণু শিল্পকলা (সংগীত), খালেদ মাহমুদ খান (মরণোত্তর) শিল্পকলা (অভিনয়), আফজাল হোসেন শিল্পকলা (অভিনয়) ও মাসুম আজিজ শিল্পকলা (অভিনয়)।
মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে মনোনীতরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব অধ্যক্ষ মো. মতিউর রহমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (মরণোত্তর), কিউ, এ বি এম রহমান ও আমজাদ আলী খন্দকার। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য এম এ মালেক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মো.আনোয়ার হোসেন, শিক্ষায় অধ্যাপক ড.গৌতম বুদ্ধ দাশ, সমাজসেবায় এস এম আব্রাহাম লিংকন ও সংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথের, ভাষা ও সাহিত্যে কবি কামাল চৌধুরী ও ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, গবেষণায় ড. মো. আব্দুস সাত্তার মন্ডল, ড. মো. এনামুল হক (দলগত), (দলনেতা), ড. সাহানাজ্ সুলতানা (দলগত) ও ড. জান্নাতুল ফেরদৌস (দলগত) এই পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন।
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে মোনঘরের নির্বাহী পরিচালক অশোক কুমার চাকমার এক লেখায় জানা যায় যে, পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের নীতি ও আদর্শের সাথে সংগতি রেখে সমাজ সম্পৃক্ততামূলক (Socially engaged Buddhism) শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত হলেন গুরুভান্তে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরো। তাঁরই উদ্যোগে ও নেতৃত্বে অনাথ, অসহায় ও দুঃস্থ শিশুদের শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে দীঘিনালায় বোয়ালখালীতে পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে তাঁরই নির্দেশে ও আর্থিক সহযোগিতায় রাঙ্গামাটিতে রাঙ্গাপানি গ্রামে মোনঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সময় বোয়ালখালী পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মোনঘর সগৌরবে টিকে আছে। পাহাড়ের আনাচে কানাচে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় মোনঘর আজ ‘শিক্ষার বাতিঘর’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন চট্টগ্রাম, জয়পুরহাট ও রংপুরেও তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
সদ্ধর্মাদিত্য শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ১৯৫৮ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন। বর্তমান মহালছড়ি উপজেলাধীন মুবাছড়ি গ্রামের সদ্ধর্মপ্রাণ দায়ক বিন্দু কুমার খীসার আমন্ত্রণে ঐ গ্রামের বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে এসেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়ে মুবাছড়ি বৌদ্ধ বিহার পানিতে তলিয়ে যায়। তারপর শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরো বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে দীঘিনালাস্থ বোয়ালখালী দশবল রাজ বৌদ্ধ বিহারে গমণ করেন।
তিনি খুব কাছে থেকে পাহাড়ি মানুষের সমাজ পরিবর্তন ও দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধের অভিঘাত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমাজের মধ্যে চরম দারিদ্র্য, জীবন-জীবিকার চরম অনিশ্চয়তা ও শিক্ষাহীনতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের চরম দুঃখ দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এ অবস্থায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হলেও তিনি নিজেকে সমাজ বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। মহা কারুণিক গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা “বহুজন হিতায, বহুজন সুখায” – বহু জনে কল্যাণের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য তিনি সমাজ সম্পৃক্ততামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের মৈত্রী-করুণা-মুদিতার ধারনাকে সমাজ জীবনে প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন সফলভাবে। ধর্ম, নৈতিক শিক্ষার প্রসার তথা সমাজের দারিদ্র্য, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি দূর করবার লক্ষ্যে তিনি শিক্ষাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাই তো নৈতিক শিক্ষার জন্য পালিটোল/পালি কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সাধারণ শিক্ষাকে। সাধারণ শিক্ষা গ্রহণকে ভিক্ষু-শ্রামণদের জন্যও উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ধর্মের চেতনার সাথে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে কোন বিরোধ দেখেননি। বরং দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করে ধর্ম শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার উন্নয়নকে সমানতালে এগিয়ে নিয়েছিলেন।
শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কল্যাণমূলক কাজ সহজসাধ্য ছিলো না। তিনি দান-দক্ষিণার পাশাপাশি সাধারণ গ্রামবাসীদের নিকট হতে মুষ্টিভিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি গ্রামের মানবতাবাদী বিত্তবান পরিবারসমূহের কাছ থেকে মাসিক দান (চাল) এবং ভিক্ষুসংঘের নিকট হতে এককালীন দান ইত্যাদি দিয়েই অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। মুষ্টিভিক্ষা ও সাধারণ দায়ক-দায়িকাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান সদ্ব্যবহার করতে পারলে সেটা কত যে ফল দিতে পারে, সেটার প্রকৃত উদাহরণ হলো পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ ও মোনঘর।
শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের ১৯৬১ সালে যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন, সেটা আজ মহীরূপে পরিণত হয়েছে। ফুলে ফলে ভরে উঠেছে চারদিকে। পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম ও মোনঘরে অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীরা কেবল বাংলাদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সরকারি, বেসরকারি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড় ও সমতলে সমান তালে আলো দিয়ে যাচ্ছে।
১৯৬১ সাল থেকে ২০২২। ৬১ বছরের কর্মযাত্রা। আজকে ‘একুশে পদক ২০২২’-এর মাধ্যমে শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথের মহোদয়ের সেই মহান আত্মত্যাগ ও কর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। গুরুভান্তের বয়স এখন ৯৭। প্রাকৃতিক নিয়মে জরাধর্ম তাঁর শরীরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করলেও তাঁর মনের জোরকে থামাতে পারেনি। সমাজের কল্যাণে তাঁর কর্ম স্পৃহা অদম্য, অজেয় বলে উল্লেখ করেন অশোক কুমার চাকমা।