খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ির স্কুল পড়ুয়া একটি কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মহালছড়ি সদর ইউনিয়নের টিলাপাড়া নিবাসী আল আমিন (২৪) এর নেতৃত্বে ৪ সেটেলার যুবক মেয়েটিকে একা পেয়ে ধর্ষণ করে।
এই খবরটা ইতিমধ্যে সকলেই জেনেছেন। ঢাকার খবরের কাগজে, দায়িত্বশীল অনলাইন নিউজ পোর্টালে এই খবরটা এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা এইটা নিয়ে পোস্ট লিখছেন, ক্ষোভ জানাচ্ছেন। স্থানীয় পুলিশ জানে, বেসামরিক প্রশাসন জানে, সবাই জানে। কিন্তু এই ঘটনায় কোন মামলা হয়নি, অভিযুক্ত যুবকদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। কেন? কেননা স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন কুমার শীল ব্যাপারটা দুই পক্ষের মধ্যে নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। কিভাবে? আত্মস্বীকৃত ধর্ষক ভিক্তিম কিশোরীটিকে দশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিবে!
পুলিশের ভাষ্য কি সেটা পরে বলছি। আগে বলে নিই ভিক্টিম মেয়েটা ও তার পরিবারের কথা। নাম ঠিকানা বলছি না। ১৪ বছর বয়সী এই মেয়েটা মহালছড়িতেই একটা হাই স্কুলে পড়ে। পিতা দরিদ্র আদিবাসী জুমচাষি। ওদের বাড়ি মহালছড়ি থেকেও একটু ভিতরের দিকে। পাহাড়ের যে গ্রামে ওর বাড়ি সেখানে কোন স্কুল নাই, হাই স্কুলে পরতেই তাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে মহালছড়ির আশেপাশেই একটা মারমা গ্রামে এসে বাস করতে হয়। এইরকম প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র জুম চাষি পিতা, তাঁর পক্ষে তো আর সেটেলার মাস্তানদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না। সেই সাহসই বেচারার হবে না।
তার উপর আবার ইউপি চেয়ারম্যান, যিনি আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, তিনি তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ আর এলাকার মুরুব্বী কয়েকজনকে সাথে নিয়ে দরবারের মধ্যে যদি সিদ্ধান্ত দেন যে এই দশ হাজার টাকা নিয়ে যাওঁ আর ধর্ষণের কথা ভুলে যাও, মামলা করবে না- এই হতভাগা জুম চাষির পক্ষে কি আর কিছু করার সাহস হবে? হবে না। এইখানেও এটাই হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য শোনেন। বাংলা ট্রিবিউন বলছে, “মহালছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহাঙ্গীর মুঠোফোনে জানান, থলিপাড়া এলাকায় এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে শুনে ঘটনাস্থলে টিম পাঠানো হয়েছিল। তবে ভিকটিমের পরিবার এ বিষয়ে আইননি সহায়তা চান না বলায় পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছে না।”
পুলিশ তো এইটা ফালতু কথা বলছে আরকি। একজন ভিক্তিম বা তাঁর পরিবার আইনি সহায়তা চাইলো কি চাইলো না সেটা জরুরী নয়। একটা ধর্ষণ হয়েছে, পুলিশ সেটা জানে। ভিক্টিম কে, স্বীকৃত ধর্ষক কে সেটাও পুলিশ জানার কথা। ইউপি চেয়ারম্যান তো জানেনই। এরপর তো পুশেরই দায়িত্ব হচ্ছে এই ঘটনায় মামলা করা, আসামীদের গ্রেফতার করা, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে চালান দেওয়া, তদন্ত করে চার্জ শিট দেওয়া ইত্যাদি। ভিক্টিমকেই যে মামলা করতে হবে বা তার পরিবারকে মামলা করতে হবে সেটা তো আইনগতভাবে আবশ্যক কোন বিষয় নয়। পুলিশ নিজেই মামলা করতে পারে।
আর ধর্ষণ তো কোন আপোষযোগ্য মামলাও না বা ইউপি চেয়ারম্যান বিচার করবে এমন কোন মামলাও না। বরং ইউপি চেয়ারম্যান যে ভিক্টিম ও তার পরিবারকে মামলা করতে নিষেধ করেছে তার জন্যে তো ঐ চেয়ারমান সাহেবকেও আসামীর তালিকার জুড়ে দেওয়া উচিৎ। ন্যায়বিচার অবস্ট্রাক্ট করার জন্যে তো চেয়ারম্যান সাহেবের বিরুদ্ধে একটা আলাদা মামলাও হওয়া উচিৎ আরকি।
আর পাহাড়ের যে বাস্তব পরিস্থিতি, সেখানে তো এইসব ধর্ষণ ঠিক সাধারণ আর দশটা ধর্ষণের মত নয়- এইখানে সেটেলার বাঙালী কর্তৃক পাহাড়ি একটা মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হয়, বিশেষ করে এইরকম গণধর্ষণ, সেখানে তো জাতিগত নিপীড়নের একটা এলিমেন্ট সবসময়েই থাকে। এইসব ক্ষেত্রে পুলিশকে বা বিচার ব্যাবস্থার সাথে বা প্রশাসনের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট ওদেরকে একটু বিশেষভাবে তৎপর হতে হয়। নাইলে এই অপরাধটিই শক্তিশালী বাঙালী কর্তৃক সংখ্যালঘু আদিবাসীর উপর জাতিগর নিপীড়নের একটা উদাহরণ হবে। এইটা কি ওখানকার পুলিশের ওসি বা উপজেলার ইউএনও এরা বুঝে না মনে করেছেন? বুঝে।
সেখানকার প্রশাসনের কর্তারা সকলেই জানেন যে এইখানে একটা জাতিগত নিপীড়নের এলিমেন্ট আছে, এইটা কেবল আরেকটা ধর্ষণের ঘটনা নয়। জেনেশুনে এরা এইসব ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেয়না। কেননা কোন না কোনোভাবে ওরাও জাতিগত নিপীড়নকে প্রশ্রয় দেয়। আদিবাসীদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।
আপনি সেই পিতার কথা চিন্তা করি। তাঁর কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ধর্ষণ করেছেন সেটেলাররা। আর আরেক সেটেলার ইউপি চেয়ারম্যান বলে কিনা ওকে দশ হাজার টাকা দিয়ে দাও, মামলা মোকদ্দমা করা যাবে না। ঐ চেয়ারম্যানের সন্তানাদি আছে কিনা, তার কোন কন্যা সন্তান আছে কিনা জানি না। তিনি কি কখনো অনুভব করতে চেষ্টা করবেন, যদি একদল যুবক তার শিশু কন্যাকে ধর্ষণ করে তার হাতে দশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে যায় তার কিরকম লাগবে? তিনি কি মহা আনন্দে বিচার পেয়েছি বলে সবকিছু ভুলে যাবেন?
চৌদ্দ বছরের একটা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে- তার কোন বিচার হবে না? কেন? এই শিশুটি আদিবাসী বলে? দরিদ্র ঘরের মেয়ে বলে?
* লেখাটি ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক থেকে নেওয়া